বনের রাজত্ব নিয়ে বাঘ-সিংহের দ্বৈরথের বহু গল্প প্রচলিত আছে। সিংহ নাকি বাঘ- বনের রাজা কে তা নিয়েও তুমুল দ্বন্দ্ব। এবার অবশ্য এই দুই প্রাণী নয়, উপকূলীয় একটি বনের জায়গার দখলদারত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে দুই প্রশাসন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ- দুই সংস্থা বঙ্গোপসাগরের তীরে জেগে ওঠা ওই বনের মালিকানা দাবি করছে।
বন বিভাগের দাবি, জায়গাটি তাদের নিজস্ব এবং বন আইনের ৪ ধারায় নোটিফায়েডভুক্ত। তবে সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে জেলা প্রশাসন বলছে, জায়গাটি তাদের খাস খতিয়ানভুক্ত।
দুই সংস্থার দাবি করা এই বনটির অবস্থান নগরীর উত্তর কাট্টলীর পোর্ট লিংক রোডের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর লাগোয়া। সীতাকুণ্ডের ছলিমপুর মৌজায় এই বনটি পড়েছে।
বনের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু চলতি মাসের শুরুতে, জেলা প্রশাসন ওই বনে পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু করলে। ওই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বেশ কিছু গাছ কাটা পড়ে। সেটিকে সামনে এনে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। তাদের আপত্তির মুখে জেলা প্রশাসন কাজও বন্ধ করে। পরে এ নিয়ে বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও বাড়ে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এই ম্যানগ্রোভ বন এত বছর ধরে বেদখল ছিল। ২০০৪ থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সলিমপুর থেকে কাট্টলী এলাকায় চারটি ইটভাটা পরিচালিত হয়েছে। সলিমপুর থেকে কাট্টলী উপকূল বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় ইটভাটাগুলো সরকারি খাসজমির মাটি এবং গাছ কেটে ব্যবহার করেছে। ২০২০ ও ২১ সালে ইটভাটা উচ্ছেদের পর ২০২৩ সালের জানুয়ারি এবং মে মাসে জেলা প্রশাসন দুই দফায় সেখানে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। ৪ জানুয়ারি সলিমপুর মৌজায় ১৯৪ একর জায়গা উদ্ধার করে। এরপর এর কিছু জায়গায় গড়া হয় ‘ডিসি পার্ক’। সেখানে ফেব্রুয়ারিতে ফুল উৎসবের আয়োজনও করা হয়। এখন বাকি জায়গায় একটি ওয়াচ টাওয়ার ও পাখির অভয়ারণ্য করার পরিকল্পনা নিয়েছে জেলা প্রশাসন। ভবিষ্যতে জায়গাটি দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে সেখানে গাছ লাগানো ও নিরাপদ পর্যটন কেন্দ্রের ঘোষণাও দিয়েছে প্রশাসন। এর পরই মূলত দ্বন্দ্বের শুরু।
জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘৭৫২ একর সরকারি খাস জায়গা বর্তমানে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আসায় বন বিভাগ আর আগের মতো ইটভাটার রমরমা বাণিজ্যের ভাগীদার হতে পারছে না। মাটি ও গাছের অবাধ যে বাণিজ্য দুই যুগ ধরে করে আসছিল, সেই ব্যবসায়ও ভাটা পড়েছে। এ কারণে বন বিভাগের অসাধু লোকজন এবং পরিবেশ বিনষ্টকারীদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। সে জন্য তারা জেলা প্রশাসনের বিপক্ষে লেগেছে, খাস খতিয়ানভুক্ত জমিকে নিজেদের দাবি করছে।’
তবে বন বিভাগ বলছে ভিন্ন কথা। চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ‘ওই বনটি ১৯৯১ সালে বন বিভাগের সৃজন করা। এর আগে ১৯৮৫ সালে গেজেটের মাধ্যমে এটিকে ৪ ধারায় নোটিফায়েড করা হয়। এখন সেই বনের ১২টি কেওড়াগাছ ও প্রায় ৫ হাজার বাইনগাছ কেটে ফেলা হয়েছে বলে ধারণা করছি।’
সে জন্য বিষয়টি ওপরের মহলকে অবহিত করার কথা জানিয়েছেন মোহাম্মদ আবদুর রহমান।
তবে সাত বছর আগে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক চিঠির কথা উল্লেখ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ওই এলাকায় সবটাই ডিসির ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জমি। এমনকি সবশেষ দীয়ারা জরিপেও বন বিভাগের কোনো জায়গা সেখানে নেই।
তিনি বিভিন্ন সময়ে ধারণ করা ওই বনের বেশ কিছু স্যাটেলাইট ইমেজ পাঠান। যেখানে গত ২০ বছর ধরে এই বনের গাছ নিধনের চিত্র দেখা যাচ্ছে।
জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানও উপকূলীয় বনের এই জায়গাটি ১ নম্বর খতিয়ানভুক্ত খাস জায়গা বলে জানান। তিনি বলেন, ‘সেখানে পাখি ও বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থলসহ একটা গ্রিন এরিয়া গড়ে তোলা হবে। এ জন্য কাজ চলছে। আর আমরা গাছ কাটিনি। আগের অবৈধ দখলদাররা বিষ দিয়ে অনেক গাছ মেরে ফেলেছিল। সেই মরা গাছ সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন সেখানে নতুন করে গাছ লাগানো হবে।’