আমদানির খবরে ঝাঁজ কমছে কাঁচামরিচের

কয়েকদিন ধরে কাঁচামরিচের অগ্নিমূল্য। রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় বিক্রি হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়।

মূল্যবৃদ্ধির জন্য পাইকারি বিক্রেতারা সরবরাহ ঘাটতিকে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করান। তাদের বক্তব্য, বৃষ্টিতে মরিচ খেত নষ্ট হওয়ায় সরবরাহ কমে গেছে। এ কারণে দাম বেড়েছে।

তবে খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতারা বলছেন, ‘কাঁচামরিচের এই অগ্নিমূল্যের নেপথ্যে রয়েছে অসাধুদের কারসাজি। দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা গত ১০-১২ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।’

কুরবানির ঈদের আগ থেকেই মূল্যবৃদ্ধির খেলা শুরু হয়। রাজধানীর খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ৩০০ টাকায় কাঁচামরিচ বিক্রি হওয়ায় দামে লাগাম টানতে গত ২৫ জুন আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। যদিও ঈদে আমদানি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ভারতের মরিচ আসতে পারেনি।

তবে রোববার ভারত থেকে পণ্যটি আসতে শুরু করলে রাজধানীসহ সারা দেশের খুচরা বাজারে কেজিতে ১২০-১৫০ টাকা কমে ৪৫০-৪৮০ টাকায় বিক্রি হয়। পাশাপাশি দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কেজিপ্রতি হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া মরিচের দাম অর্ধেকে নেমেছে। এ থেকেই প্রমাণ হয়, কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয়েছে।

রোববার কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সিনিয়র তথ্য অফিসার কামরুল ইসলাম ভূইয়া স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঈদের ছুটির পর রোববার বিকাল ৫টা পর্যন্ত দেশে ৫৫ টন কাঁচামরিচ দেশে এসেছে। রাতে আরও ট্রাক স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ঢুকবে। ৩৬ হাজার ৮৩০ টন মরিচ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ঈদের আগ থেকে এখন পর্যন্ত এসেছে ৯৩ টন।

রোববার রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজারসহ একাধিক খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাঁচামরিচ ৪৫০-৪৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা একদিন আগেও ৬০০ টাকা ছিল।

এছাড়া ফরিদপুরের বিভিন্ন খুচরা বাজারে পণ্যটি ৫২০-৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা একদিন আগেও ৭০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। সাতক্ষীরায় বিক্রি হয় ৫০০-৫৫০ টাকা, যা একদিন আগে শনিবার ৭০০-৭৫০ টাকা ছিল। চুয়াডাঙ্গার খুচরা বাজারে শনিবার কেজিপ্রতি হাজার টাকায় বিক্রি হলেও ভারত থেকে মরিচ আসার খবরে রোববার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।

রাজধানীর নয়াবাজারের সবজি বিক্রেতা মো. নুরে আলম বলেন, পাইকারি বাজারে পণ্যটির দাম অনেক বাড়িয়েছে। যে কারণে খুচরা বাজারে বেড়েছে। তবে আমরা খুচরা বিক্রেতারা চাহিদামতো পণ্য কিনে বিক্রি করতে পেরেছি। কিন্তু কিনতে হয়েছে অস্বাভাবিক দামে। পণ্যটির কোনো সংকট ছিল না। পাইকাররা ইচ্ছা করে সরবরাহ কমার অজুহাতে পণ্যটির দাম বাড়িয়েছে। যে কারণে ভোক্তাকে অস্বাভাবিক দামে পণ্যটি কিনতে হয়েছে। ভারত থেকে কাঁচামরিচ আসার সংবাদে পণ্যটির দাম কমাতে শুরু করেছেন পাইকাররা। যার ফলে খুচরা পর্যায়ে দাম কমেছে।

কাওরান বাজারের কয়েকজন পাইকারি বিক্রেতা বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টির কারণে মরিচের খেত নষ্ট হয়েছে। অনেক কৃষকের ফলন পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এছাড়া ভারত থেকেও পণ্যটির আমদানির অনুমোতি ছিল না। ফলে দাম বেড়েছে। পণ্যটির সংকট না থাকলেও কেন দাম বাড়ানো হলো-এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে এটাই নিয়ম।

এদিকে মরিচের দাম সহনীয় করতে কে কাজ করবে, এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে গড়িমসি চলছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপরে দায় চাপাচ্ছিল। সব শেষে শনিবার বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, কাঁচামরিচ কৃষিজাত পণ্য। এর দাম কেন বাড়ল, তা কৃষি মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। এটা আমাদের ব্যাপার না।

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, জেলার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ছয় ট্রাক ভারতীয় কাঁচামরিচ প্রবেশ করেছে। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে টানা পাঁচ দিনের ছুটি শেষে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরুর পর রোববার প্রথম চালানেই এসব কাঁচামরিচ দেশে এসেছে।

ভোমরা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খান জানান, পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটি শেষে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রোববার দুপুর ২টা পর্যন্ত ৬ ট্রাক কাঁচামরিচ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আরও কিছু ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে।

এদিকে ভারতের মরিচ আসার সঙ্গে সঙ্গে সাতক্ষীরার বড় বাজারে প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫৫০ টাকায়। একদিনের ব্যবধানে ২০০ টাকা কমেছে। শনিবারও প্রতি কেজি কাঁচামরিচ ৭০০-৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, বেনাপোল বন্দর দিয়ে রোববার বিকালে ৫টি ট্রাকে করে ৩৪ মেট্রিক টন কাঁচামরিচ দেশে প্রবেশ করেছে।
বেনাপোল স্থলবন্দর উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের উপ-সহকারি কর্মকর্তা হেমন্ত কুমার সরকার বলেন, ‘দেশের বাজারে ঈদের আগে থেকে হঠাৎ করে কাঁচামরিচের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার ভারত থেকে আমদানির অনুমতি দেওয়ায় আজ (রোববার) থেকে আমদানি শুরু হয়েছে।’
বেনাপোল কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার তানভীর আহমেদ বলেন, ‘কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রতিকেজি কাঁচামরিচ শূন্য দশমিক ৫০ মার্কিন ডলারে শুল্কায়ন করে খালাস করছে। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজির মূল্য ৩২ দশমিক ২০ টাকা পড়ে।

ফরিদপুর ব্যুরো জানায়, শনিবার জেলা শহরের খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাঁচামরিচ ৭০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হলেও রোববার বিক্রি হয় ৫২০-৬০০ টাকায়।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিনের ব্যবধানে কেজিতে ২০০ টাকা কমে যাওয়া সম্ভব না। পাইকারি বিক্রেতা সিন্ডেকেট করে মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করেছেন।

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন এলাকার খুচরা বাজারে শনিবার এক কেজি কাঁচামরিচ কিনতে বাজারভেদে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা গুনতে হয়েছে। তবে মাত্র একদিনের ব্যবধানে রোববার এ দাম অর্ধেকে নেমে আসে।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে কাঁচামরিচের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা দরে। সিন্ডিকেট করেই নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ ভোক্তাদের। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, অতিরিক্ত খরার কারণে উত্তর বঙ্গেও যেসব জেলায় কাঁচামরিচ উৎপাদন হয়, সেসব জেলায় উৎপাদন হয়নি। ঈদের বন্ধের কারণে ভারত থেকে চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামরিচের আমদানি হয়নি এবং দেশীয় যেসব কাঁচামরিচ বাজারে ছিল, তা চট্টগ্রামের গুটিকয়েক সিন্ডিকেট কিনে নিয়ে গুদামজাত করেছে। মূলত এসব কারণেই কাঁচামরিচের দামে এত ‘ঝাল’, যা আগে কখনোই হয়নি।

নগরীর একাধিক কাঁচাবাজার ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১০ দিন আগেও প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে মানভেদে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। এখন দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ভালোমানের কাঁচামরিচ ৭০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না।

হাকিমপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের হিলিতে কাঁচামরিচের দাম বেশি নেওয়ার অভিযোগে অভিযোন পরিচালনা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় পাঁচ দোকানিকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এই অভিযান পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (ভূমি) মোখলেদা খাতুন মীম।

যাদের জরিমানা করা হয় তারা হলেন হিলি বাজারের কাঁচামরিচ বিক্রেতা ফারুখ হোসেন (১ হাজার টাকা), শুশীল বসাক (১ হাজার টাকা), সোহেল রানা (৫০০ টাকা), জাহেদুল ইসলাম (১ হাজার টাকা) এবং মেহেদী হাসান (১ হাজার টাকা)।

দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ফরিদপুরহাটে রোববার কাঁচামরিচ কেজি বিক্রি হয় একশ টাকা। অথচ আগের দিন বিক্রি হয় ৮২০ টাকা।

উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক কার্তিক চন্দ্র রায় বলেন, ‘গতকাল শনিবার এই হাটোত প্রতিমন কাঁচামরিচ বেচিছি ১৬ হাজার ৮শ টাকা। কিন্তু আইজ (রোববার) একেই কাঁচামরিচ একেই হাটোত বেচির আনি দাম কহেচে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা। একদিনেই প্রতিমনে ১৩ হাজার টাকা নাই। অর্থাৎ একদিনেই ৪২০ টাকা কেজি দামের মরিচ নামি আইসছে ১শ টাকায়। দাম বাড়িল কেনে? আর একদিনে কমিল গেইল কেনে? তামান মনে হচে তামাশা।’

এই হাটে কাঁচামরিচ বিক্রি করতে এসে এমন হতাশার কথা জানিয়েছেন অসংখ্য মরিচচাষী।

Related Posts

  • আগস্ট ২৫, ২০২৪
  • 16 views
অভ্যন্তরীণ যত পরিবর্তনই আসুক বাংলাদেশের পাশে থাকবে চীন: রাষ্ট্রদূত

বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, বাংলাদেশের সংস্কার ও উন্নয়নে তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়, উভয় পক্ষের মধ্যে হওয়া চুক্তি ও ঐকমত্য বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত সহযোগিতা এগিয়ে নিতে প্রস্তুত…

Read more

  • আগস্ট ২২, ২০২৪
  • 45 views
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৯ লাখ মানুষ, ২ জনের মৃত্যু

ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট বন্যায় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানিয়েছে দুর্যোগ…

Read more

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You Missed

বিধবা নূর নাহারের জমি দখল করছে কারা?

বিধবা নূর নাহারের জমি দখল করছে কারা?

বৃহত্তর কলাতলী পর্যটক ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির ১৫ সদস্য কমিটি গঠিত

বৃহত্তর কলাতলী পর্যটক ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির ১৫ সদস্য কমিটি গঠিত

মগনামা ঘাটের ইজারা নিয়ে ষড়যন্ত্র, পারাপার বন্ধের ঝুঁকি

আজ রোহিঙ্গাদের সাত বছর পূর্তি, ক্যাম্পে নতুন রোহিঙ্গা প্রবেশ

আজ রোহিঙ্গাদের সাত বছর পূর্তি, ক্যাম্পে নতুন রোহিঙ্গা প্রবেশ

অভ্যন্তরীণ যত পরিবর্তনই আসুক বাংলাদেশের পাশে থাকবে চীন: রাষ্ট্রদূত

অভ্যন্তরীণ যত পরিবর্তনই আসুক বাংলাদেশের পাশে থাকবে চীন: রাষ্ট্রদূত
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৯ লাখ মানুষ, ২ জনের মৃত্যু