তরুণদের ইন্টারনেট আসক্তি বাড়ছে কেন?

gazi mizan 20230905095423
print news

আইরিশ কবি ও নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ড (Oscar Wilde) বলেছেন, ‘একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবেন তা অন্যকিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে তা অনেকাংশেই বোঝা যায়।’

অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তির যে বিষয়ের প্রতি আগ্রহ থাকে, তখন তিনি সেই বিষয় সম্পর্কিত বই পড়েন—বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য, বোঝার জন্য বা শেখার জন্য। তাই তার বই পড়ার ধরন দেখে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। তাহলে এখন প্রশ্ন হতে পারে—‘আমাদের তরুণ প্রজন্ম তো বই-ই পড়ে না। তাহলে তাদের কী হবে?’

সত্যি বলতে, কয়েক বছরে বিশেষ করে ২০১০ সাল থেকে তরুণ প্রজন্ম বইয়ের তুলায় ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, টিকটক এবং হালের লাইকিমুখী। তাদের অনেকে এখন বই পড়া বাদ দিয়ে এইসব জায়গায় সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা এইখানে সময় অতিবাহিত করে। আরেকটা শ্রেণি আছে, যারা ‘বই পড়াকে অহেতুক সময় নষ্ট করা’ মনে করে বই-ই পড়তে চায় না।

এই তো গেল বই না পড়ার শ্রেণি বা ইন্টারনেটমুখী প্রজন্মের কথা। কিন্তু যারা বই পড়ে তারা সবাই কি প্রকৃতপক্ষে পাঠক?—এখন কেউ কেউ এই প্রশ্নের উত্তরে বলবেন ‘হ্যাঁ’; আবার কেউ কেউ বলবেন ‘না’। কিন্তু এইক্ষেত্রে আমার উত্তর হচ্ছে ‘না’। কারণ, যারা বই পড়ে তারা প্রকৃতপক্ষে সবাই বইয়ের পাঠক নয়।

কথাটা শুনতে খারাপ লাগছে বা বেখাপ্পা শোনাচ্ছে? আপনার কাছে বেখাপ্পা শোনালেও এইটাই বাস্তব সত্য। ‘তাহলে এটা কী রকম বাস্তব সত্য?’—এমন প্রশ্ন মনে উত্থিত হয়েছে নিশ্চয়ই!

তাহলে বিষয়টি খোলাসা করা যাক—অতীতে সবচেয়ে বেশি বই পড়তো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে এখনকার স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বই পড়ে নিজেদের জানার জন্য নয়, বরং পরীক্ষায় পাস করার মাধ্যমে সার্টিফিকেট অর্জন করার জন্য। তাদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন প্রাইভেট-কোচিংয়ে দৌড়ায় সাজেশন ও শিটের জন্য। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে কম পড়ে বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য। ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার জন্য।

অতীতে সবচেয়ে বেশি বই পড়তো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে এখনকার স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বই পড়ে নিজেদের জানার জন্য নয়….

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কিছুটা বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। তাদের কেউ কেউ অনেক পড়ালেখা করে ক্লাসে ফার্স হতে চায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ার জন্য। আর অন্যরা কোনোমতে একাডেমিক সার্টিফিকেট অর্জন করে কোনো একটা সরকারি চাকরি বা বেসরকারি চাকরি অথবা বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেয় একাডেমিক পড়ার ফাঁকে ফাঁকে।

তাহলে এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে—একেবারে নগণ্য কিছু শিক্ষার্থী ছাড়া বাকিদের প্রায় সবাই বই পড়ে ভালো জিপিএ বা সিজিপিএ অর্জন করার জন্য কিংবা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য।

তাহলে বইয়ের মাধ্যমে যে জ্ঞান আহরণের কথা মনীষীরা বলে গেছেন তার কী হবে? আমি যদি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের বাইরেও জ্ঞান লাভের, নিজেকে সমৃদ্ধ করার যে অসংখ্য উৎস রয়েছে, তাদের অনুপ্রাণিত করব কীভাবে?

আমি দেখেছি, যেসব শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বিভিন্ন বই পড়ে, তাদের চিন্তাভাবনা অনেক বেশি পরিশীলিত। তাদের জীবনে হতাশা কম দেখা যায় এবং তাদের ভেতরে অপরাধ প্রবণতা ও মাদকাসক্তি দেখা যায় না বললেই চলে।

তাই অভিভাবকদের উচিত পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য ভালো বই বা সৃজনশীল বই তাদের ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনদের পড়তে দেওয়া, প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে মাসজুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন হয়, সেইখানে তাদের নিয়ে যাওয়া।

নতুন নতুন বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। নতুন বই সংগ্রহে ও পড়তে উৎসাহিত করা। জন্মদিনে বা বিশেষ দিবসে উপহার হিসেবে ভালো ভালো বই উপহার দেওয়া।

আজকে আমরা প্রচুর কিশোর গ্যাং-এর কথা শুনি। তারা সমাজের বখে যাওয়া সন্তান। পিতামাতার অবাধ্য। তারা সমাজের জন্য ক্যান্সারস্বরূপ। তাদের সঙ্গে বইয়ের তেমন যোগাযোগ নেই।

এই প্রসঙ্গে প্রযুক্তিজগতের কিংবদন্তি বিল গেটসের একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন—‘খুব কম বয়সেই বই পড়ার প্রতি আমার ঝোঁক তৈরি হয়। শিশু হিসেবে আমার বাবা–মাও বই কিনতে আমাকে ইচ্ছেমতোই টাকা দিতেন। তাই আমি প্রচুর পড়তাম।’

ছেলেমেয়েদের পাঠাভ্যাস তৈরি করার গুরুদায়িত্ব কিন্তু অভিভাবক ও স্বজনদের। তারপরের স্থানে রয়েছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা যত বই পড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তারা তত বেশি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। পরিবার ও সমাজের সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।

আরও পড়ুন >>> শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

আজকে আমরা প্রচুর কিশোর গ্যাং-এর কথা শুনি। তারা সমাজের বখে যাওয়া সন্তান। পিতামাতার অবাধ্য। তারা সমাজের জন্য ক্যান্সারস্বরূপ। তাদের সঙ্গে বইয়ের তেমন যোগাযোগ নেই। তাদের যোগাযোগ বখাটে ছেলেমেয়েদের সাথে।

আজ যদি তারা বইমুখী হতো, নিজের ভালোমন্দ, সমাজের ভালোমন্দ উপলব্ধি করতে পারত সঠিকভাবে, তাহলে তাদের এই অবস্থা হতো না।

বই যেমন ব্যক্তিজীবন সমৃদ্ধ করে, ঠিক তেমনিভাবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে সমাজকে সমৃদ্ধ করে। আপনি যদি চান যে আপনার ছেলেমেয়ে চিন্তা ও বুদ্ধিতে পরিপক্ক হয়ে ওঠুক, রুচিতে মার্জিত ও পরিশীলিত হয়ে উঠুক, তাহলে তাদের বেশি বেশি ভালো বই পড়তে দিন।

আসুন, আমরা নিজেরা বই পড়ি এবং ছেলেমেয়ে ও প্রিয়জনদের ভালো ভালো বই উপহার দেই। বই পড়তে উৎসাহিত করি।

গাজী মিজানুর রহমান
।। ৩৫তম বিসিএস ক্যাডার; লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *