চার রোহিঙ্গা শরণার্থীর মৃতদেহ নিয়ে বিপাকে পুলিশ। দুই জনের মৃতদেহ ১১ বছর, একজনের নয় এবং একজনের মৃতদেহ পাঁচ বছর ধরে সংরক্ষিত রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) মর্গের ডিপফ্রিজে।
চার শরণার্থীর মৃতদেহ সংরক্ষণে বকেয়া জমেছে ১৩ কোটি টাকারও বেশি। বকেয়া টাকা পরিশোধ করে মৃতদেহগুলো নিয়ে যাবার অনুরোধ জানিয়ে চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে নগর পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে বেশ কয়েকবার। এর মধ্যে পাঁচলাইশ থানার ওসি পরিবর্তন হয়েছে অন্তত পাঁচজন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালে দুটি, ২০১৪ সালে একটি ও ২০১৭ সালের একটিসহ মোট চারজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর মৃতদেহ দীর্ঘদিন ধরে চমেক হাসপাতালের মর্গে সংরক্ষিত আছে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ায় বর্তমানে মৃতদেহগুলো আকৃতিগতভাবে নষ্ট হওয়ার শেষ পর্যায়ে। চারটি মৃতদেহ যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সিএমপি কমিশনারকে চিঠি দেয় চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ।
বকেয়া ১৩ কোটি : ২০১২ সালের ২৬ অক্টোবর চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ থেকে বকেয়া পাওনা চেয়ে পাঁচলাইশ থানার ওসির কাছে প্রথম চিঠি দেয়া হয়। সেই সময় দুই লাশের ডিপফ্রিজ ভাড়া বকেয়া ছিল এক লাখ ৪২ হাজার টাকা। চিঠিতে বলা হয়েছে দুটি লাশের প্রতিদিন ডিপফ্রিজ ভাড়া দুই হাজার টাকা বাড়বে। এরমধ্যে ডিপফ্রিজে জমা হয়েছে রোহিঙ্গা সাইথাং থো ও হাফেজ সিরাজের মৃতদেহ।
ফরেনসিক বিভাগের দেয়া চিঠির তথ্য অনুযায়ী দশ বছরের অধিক সময় ধরে মর্গে পড়ে থাকা চার মৃতদেহের মধ্যে ২০১২ সালের ১৩ জুন থেকে ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত কালা হোসেনের মৃতদেহের ভাড়া বকেয়া পড়েছে তিন কোটি ৭৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। একইভাবে ২০১২ সালের ১৭ জুন থেকে ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত তৈয়বের মৃতদেহের বকেয়া ভাড়া তিন কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার, ২০১৪ সালের ২৩ মে ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সাইথাং থো এর মৃতদেহের বকেয়া ভাড়া তিন কোটি আট লক্ষ ৯০ হাজার ও ২০১৭ সালের ১৪ মে থেকে ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত হাফেজ সিরাজের মৃতদেহের ভাড়া বকেয়া হয়েছে এক কোটি ৯৮ লাখ ৫০ হাজার। চলতি বছর পূর্ণ হলে প্রত্যেক মৃতদেহের মর্গের বকেয়া ভাড়ায় আরো সাত লাখ ৩০ হাজার করে আরো প্রায় ৩০ লাখ টাকা বকেয়া বাড়বে।
পাঁচলাইশ থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা জানান, বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেভাবে নির্দেশনা দেবেন সেভাবে কাজ করা হবে।
ডিপফ্রিজে ৪ লাশ : ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মিয়ানমারে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় রোহিঙ্গা নাগরিক আবু তৈয়ব (২০) ও কালা হোসেন (৫০) নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা হয়। আহত দুইজনকে জরুরি চিকিৎসা নিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) পাঠায় কক্সবাজার মডেল থানা পুলিশ। চমেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১২ সালের ১৭ জুন আবু তৈয়ব ও ১২ জুন কালা হোসেন মারা যায়। নিয়ম অনুযায়ী পাঁচলাইশ থানা পুলিশ দুই জনের মৃতদেহ সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করেন। ময়নাতদন্তের পর প্রায় সাড়ে দশ বছর ধরে দুইজনের মৃতদেহ চমেক হাসপতাল মর্গের ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষিত রয়েছে। একইভাবে ২০১৪ সালের ২৩ মে থেকে এবং ২০১৭ সালের ১৪ মে থেকে আরো দুই রোহিঙ্গা সাইথাং থো ও হাফেজ সিরাজের মৃতদেহ সংরক্ষিত আছে চমেকের ডিপ ফ্রিজে।
এদিকে ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট ডিপফ্রিজে দুই রোহিঙ্গার মৃতদেহ সংরক্ষণ বাবদ এক লাখ ৪২ হাজার টাকা বিল দাবি করে পাঁচলাইশ ওসির কাছে একটি চিঠি পাঠায় চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ। ফরেনসিক বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, দুটি মৃতদেহ ডিপফ্রিজে সংরক্ষণ বাবদ প্রতিদিন দুই হাজার টাকা করে বকেয়া বিল বাড়ছে। এরপর থেকে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ, চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ, কক্সবাজার মডেল থানা, নগর বিশেষ শাখার মধ্যে চিঠি চালাচালি হয় দফায় দফায়। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে বাংলাদেশস্থ মিয়ানমার দূতাবাস পর্যন্ত গড়ায়। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দুইজনের বিরুদ্ধে কক্সবাজার ও টেকনাফ থানায় মামলা রয়েছে।
২০১২ সালের ২৬ জুলাই নগর পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে একটি চিঠি পাঠানো হয় কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে। বিশেষ শাখার পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা নাগরিক আবু তৈয়ব ও কালা হোসেন চিকিৎসাধীন অবস্থায় চমেক হাসপাতালে মারা যায়।
দুইজনের মৃতদেহ মিয়ানমারে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকাস্থ মিয়ানমার দূতবাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হয়। উত্তরে মিয়ানমার দূতাবাস জানান, নিহতরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। কারণ তাদের কাছে মিয়ানমারের জাতীয় পরিচয়পত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড নেই। তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রচলিত বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে মিয়ানমার দূতাবাস। সুত্র: পূর্বকোণ