ওপারের যুদ্ধে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘অস্বস্তি’

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যুদ্ধ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সেই উত্তেজনার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায়ও। সীমান্তের ওপারে বর্ষণ করা মর্টারশেল ও গুলি এসে পড়ছে এপারে। এতে সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশিরা রয়েছে চরম আতঙ্কে। এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজারজুড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসতি ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতিও থমথমে।

ক্যাম্পের সূত্র দাবি করছে, মিয়ানমারে যুদ্ধে শুধু সংহতি নয়, বেশ কিছু তরুণ রোহিঙ্গা যুদ্ধে যোগ দিতে গেছে এবং যেতে চাচ্ছে। যদিও এর সমর্থনে কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রত্যাবাসন কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যাম্পে প্রকাশ্যে কোনও কিছুর প্রভাব লক্ষ করা না গেলেও গোপনে অস্বস্তি আছে। বর্তমানে উখিয়ার দিকে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হলেও সংঘর্ষ টেকনাফের দিকে গিয়েছে।

প্রায় ২০ দিন ধরে চলা সংঘর্ষের কারণে আবারও অনুপ্রবেশের শঙ্কা দেখা দিয়েছে সীমান্ত এলাকায়। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ইতোমধ্যে বলেছেন, মিয়ানমার থেকে আর কাউকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এমনিতেই প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। এবার মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বা যে-ই আসুক, কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে অজানা শঙ্কা বিরাজ করছে।

এর মধ্যে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার কিছুটা শান্ত হয়েছে। তবে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে শোনা গেছে ভারী গোলাগুলির শব্দ।

ক্যাম্পের পরিস্থিতি কেমন, জানতে চাইলে বালুখালি ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা বলেন, এখানে কোনও ঝামেলা নেই। কিন্তু আমরা তো ওপারেরই মানুষ। ওখানে লড়াই চললে সেই আঁচ আমাদের মধ্যে লাগে। আমাদের প্রতি আচরণ কেমন হবে, ওখানে কী পরিস্থিতি হচ্ছে, এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে অস্থিরতা আছে। তরুণ রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ ওপারে গিয়ে যুদ্ধে যুক্ত হতে চায়। জান্তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে তাদের এই যুদ্ধে যাওয়ার স্বপ্ন। এরা বুঝে বা না বুঝে অংশ হতে চায়। সেসব নিয়ে দফায় দফায় নিজেদের মধ্যে বসছি আমরা।

ক্যাম্প থেকে বের হওয়া ও ঢোকা নিয়ে কোনও সমস্যা আছে কিনা বা বাড়তি নিরাপত্তা দেখছেন কিনা, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, বালুখালিতে খুব বেশি কড়াকড়ি নেই, কিন্তু সতর্কতা আছে। কেউই বিষয়গুলো সামনে আনতে চায় না। ওটা তো আমাদের দেশ। তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ যে নেই তা নয়। আমরা যখন দেশে ফিরতে চাই, তখন সরকার পর্যায়ের আলাপ এগিয়ে নিতে আমাদেরও দ্বিপক্ষীয় কিছু যোগাযোগের বিষয় উপাদান হিসেবে কাজ করবে বলে বিশ্বাস। তবে কিছু বিষয়ে ক্যাম্পের ভেতরে নজরদারি আছে।

কেউ ‍যুদ্ধে যোগ দিয়েছে কিনা, জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুতুপালং ক্যাম্পের স্টুডেন্ট লিডার বলেন, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ আগে থেকেই। রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো যখন দেখেছে আরাকান আর্মি অনেক শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করছে জান্তাদের বিরুদ্ধে, তখন কেউ কেউ যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। যারা নতুন যুদ্ধে যুক্ত হচ্ছে, তাদের এক-দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়েই ওপারে পাঠানো হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। তবে আমরা উৎসাহিত করিনি।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি একটি আইন পাস করেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। ওই আইন অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী পুরুষ ও ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী নারীদের বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে হবে। তাদের সর্বোচ্চ দুই বছর বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে রাষ্ট্রের জরুরি অবস্থার সময় এটি পাঁচ বছরও হতে পারে।

ক্যাম্পের পরিস্থিতি জানতে চাইলে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (উপসচিব) মোহাম্মদ সামসুদ্দৌজা বলেন, ক্যাম্পে প্রকাশ্যে কোনও অস্থিরতা নেই, তবে গোপনে অস্বস্তি আছে। সেটা তো থাকারই কথা।

তিনি আরও বলেন, দেশটিতে নতুন আইন পাস করার মধ্য দিয়ে সবাইকে যুদ্ধ করার যে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে, সেটাও ক্ষোভের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। এখন উখিয়ার দিকে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে সংঘর্ষ টেকনাফের দিকে গেছে।

ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে জানতে ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ইকবালের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক। ক্যাম্প থেকে ওপারে রোহিঙ্গাদের যাওয়ার খবরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কাউকে ঢুকতেও দেবো না, বের হতেও দেবো না। ফলে ওপারে যাওয়ার কথাটি সত্য নয়।

উল্লেখ্য, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ওপার থেকে আসা গোলাবর্ষণে ইতোমধ্যে দুজন নিহত হয়েছেন। মর্টারশেল এসে পড়েছে বাংলাদেশির ঘরে, গুলি লেগেছে অটোরিকশায়। বিদ্রোহীদের সঙ্গে তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যসহ কয়েকশ’ মানুষ বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে তারা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে রয়েছেন। বৈশ্বিকভাবে আলোচনার পরও তাদের ফেরানোর কোনও উদ্যোগ এখনও সফল হয়নি। এবারের সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে নতুন করে আশ্রয় নেওয়া এই কয়েকশ’ মানুষকে ফেরানোর বিষয়েও নানা আলোচনা চলছে।

  • Related Posts

    • অক্টোবর ২৪, ২০২৪
    • 78 views
    অভয়ারণ্যে ট্রেনের ধাক্কায় হাতি নিহত, লোকোমাস্টার বরখাস্ত

    কক্সবাজারের চুনতি অভয়ারণ্য এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় এক হাতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনের লোকোমাস্টার জামাল উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোরব) পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা…

    Read more

    • অক্টোবর ২৪, ২০২৪
    • 32 views
    ঈদগাঁওতে রহস্যজনক মৃত্যু হাতি শাবকের

    কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদে এক বন্য হাতির বাচ্চার মৃত্যু হয়েছে। ফুলছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সকালে ইসলামাবাদ গজালিয়ার সাতঘরিয়াপাড়া সংলগ্ন গর্জনতলা নামক স্থান…

    Read more

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত রহিম সাংবাদিক-কে ম্যনেজ করতে না পেরে মামলার হুমকি

    ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত রহিম সাংবাদিক-কে ম্যনেজ করতে না পেরে মামলার হুমকি

    ধর্ষকের পক্ষে ওসি (তদন্ত)মামলা না করতে ভীতি প্রদর্শন-ভূক্তভুগী স্বপরিবারে আত্মহত্যার সম্ভাবনা

    ধর্ষকের পক্ষে ওসি (তদন্ত)মামলা না করতে ভীতি প্রদর্শন-ভূক্তভুগী স্বপরিবারে আত্মহত্যার সম্ভাবনা

    এজাহার দিতে গিয়ে আসামি হয়ে জেলে, ন্যায় বিচারের দাবিতে পরিবারের আর্তনাদ

    এজাহার দিতে গিয়ে আসামি হয়ে জেলে, ন্যায় বিচারের দাবিতে পরিবারের আর্তনাদ

    রংপুরে জামায়াতের অমুসলিম শাখার কমিটি গঠন

    রংপুরে জামায়াতের অমুসলিম শাখার কমিটি গঠন

    গণমাধ্যম ঘেরাওয়ের হুমকি, কড়া হুঁশিয়ারি সরকারের

    গণমাধ্যম ঘেরাওয়ের হুমকি, কড়া হুঁশিয়ারি সরকারের

    গণমাধ্যমে ছাত্রলীগের প্রচার না করার আহ্বান মাহফুজ আলমের

    গণমাধ্যমে ছাত্রলীগের প্রচার না করার আহ্বান মাহফুজ আলমের