বাবার সঙ্গে বিরোধে হত্যার পর লাশ ডোবায় পুঁতে রাখেন গৃহশিক্ষিকা

WhatsApp Image 2024 11 10 at 18.18.24 4e23dade
print news

অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে লাশ হয়ে ফিরল পাঁচ বছরের নিষ্পাপ শিশু মুনতাহা আক্তার। শিশুটিকে হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য ডোবায় পুঁতে রাখা হয়েছিল। গতকাল রোববার ভোরে মাটিতে পুঁতে ফেলা মরদেহ তুলে মুনতাহার চাচার বাড়ির পুকুরে ফেলার সময় হাতেনাতে শিশুটির গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম ওরফে মার্জিয়ার মা আলিফজান বেগমকে আটক করেন স্থানীয়রা। এ সময় গলায় রশি প্যাঁচানো অবস্থায় মুনতাহার মরদেহ দেখতে পান তারা। এ ঘটনায় এই দুজনসহ ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ।

নিহত মুনতাহা সিলেটের কানাইঘাট সদরের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে। নিষ্পাপ শিশুটির হত্যাকাণ্ডে শোকে স্তব্ধ কানাইঘাট। শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো সিলেটজুড়ে। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল রোববার বিকেল ৪টায় শিশুটির মরদেহ বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার জানাজায় হাজার হাজার শোকার্ত মানুষ অংশ নেয়।

গত ৩ নভেম্বর আপেল খেতে খেতে প্রতিবেশী গৃহশিক্ষিকা মার্জিয়ার ঘরে প্রবেশ করে মুনতাহা। যে ঘরে বই-খাতা নিয়ে পড়তে বসত মুনতাহা, সেই চেনা ঘরেই তাকে গলা চেপে হত্যা করে মার্জিয়া। পরে শিশুর নিথর দেহ মার্জিয়া ও তার মা মিলে বাড়ির পেছনের ডোবায় পুঁতে রাখে। মার্জিয়া নিজেই পুলিশের কাছে এমন বক্তব্য দিয়েছে বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন সিলেট জেলা পুলিশের কানাইঘাট সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার অলক কান্তি শর্মা। তিনি বলেন, এ ঘটনায় আটক মার্জিয়া ও আলিফজানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রাথমিকভাবে তারা পুলিশকে জানিয়েছে, মুনতাহার বাবার সঙ্গে তাদের বিরোধ রয়েছে। তবে কী নিয়ে বিরোধ, তা জানা যায়নি।

পুলিশ জানায়, শিশুটির মরদেহ ডোবায় কাদার মধ্যে পুঁতে রাখা ছিল। মার্জিয়া আটক হওয়ার পর তার মা আলিফজান লাশটি ডোবা থেকে তুলে গতকাল ভোরে শিশুটির চাচার বাড়ির পাশে একটি পুকুরে ফেলে আসতে যায়। পথে স্থানীয়রা হাতেনাতে তাকে ধরে ফেলেন। পুলিশ আরও জানায়, প্রায় এক সপ্তাহ মরদেহ কাদামাটিতে চাপা থাকায় পচে মাথার খুলি বেরিয়ে গেছে। এ ঘটনায় মার্জিয়া ও তার মা আলিফজান ছাড়াও মার্জিয়ার নানি কুতুবজান, প্রতিবেশী নিজাম উদ্দিন, ইসলাম উদ্দিন ও নাজমা বেগমকে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ।

তাদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, ৩ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়ার দিনই তাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর মরদেহ ঘরের পাশের একটি খালে কাদামাটিতে চাপা দিয়ে রাখা হয়। আজ (রোববার) ভোরে আলিফজান বেগম মরদেহ সরানোর চেষ্টাকালে স্থানীয়রা দেখে ফেলেন। এ সময় স্থানীয়রা থানায় খবর দিলে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। এ সময় মার্জিয়া, তার মা ও নানিকে আটক করা হয়েছে। আলিফজান ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করত। কী কারণে মুনতাহাকে হত্যা করা হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।

৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে স্থানীয় একটি ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফেরে শিশু মুনতাহা। পরে আশপাশের বাড়িতে শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে যায়। কিন্তু বিকেল হলে বাড়ি না ফিরলে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। তারপর তাকে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। নিখোঁজের পর থেকে পরিবার দাবি করে আসছিল, পরিকল্পিতভাবে মুনতাহাকে অপহরণ করা হয়েছে। নিখোঁজের ঘটনায় কানাইঘাট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছিল পরিবার। শিশুটিকে খুঁজে পেতে পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল তারা। তবে মুনতাহাকে আর জীবিত ফিরে পাওয়া যায়নি।

কানাইঘাট সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন আহমদ বলেন, মুনতাহার নিখোঁজের পর থেকে পুলিশ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোনো ক্লু পাচ্ছিল না। শনিবার স্থানীয় সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে গেলে মার্জিয়ার আচরণ সন্দেহজনক মনে করেন। পরে রাতে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। এরপর স্থানীয় ইউপি সদস্যকে মার্জিয়ার বাড়ির আশপাশে মাটি খোঁড়া আছে কি না, খোঁজ নিতে বলে।

তিনি বলেন, পুলিশের তথ্যমতে মুনতাহার স্বজনসহ স্থানীয়রা আজ (রোববার) রাতভর মাটি খোঁড়া কোনো জায়গা আছে কি না, খুঁজতে থাকেন। ফজরের আজানের আগ মুহূর্তে মার্জিয়ার মা আলিফজান বিবিকে হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে রাস্তা পার হতে দেখে আটকানোর চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে স্থানীয়রা তাকে আটক করেন। পরে কাদামাটি মাখা মুনতাহার মরদেহ দেখতে পান। আটকের পর তিনি জানিয়েছেন, মরদেহ প্রথমে মাটিতে পুঁতে ফেলেছিল। রাতে সেখান থেকে মরদেহ তুলে মুনতাহার চাচার বাড়ির পুকুরে ফেলতে চেয়েছিল।
মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমি এতদিন যাদের খুব অসহায় ভেবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছি, তারাই আমার মেয়েকে হত্যা করে লাশ লুকিয়ে রাখল। আমি ভাবতেই পারিনি তারা এমন কাজ করতে পারে। আমি সারা দেশে মেয়েকে খুঁজতেছি, কিন্তু আমার বাড়ির পাশেই পেছন গেট থেকে মেয়েটিকে নিয়ে মেরে ফেলে রেখেছে ওরা। আমি ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
এ বিষয়ে সিলেট জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, শিক্ষকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় ক্ষোভ থেকে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করছি।
সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, মার্জিয়ার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৩ নভেম্বর রাতেই মুনতাহাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর ডোবায় ফেলে রাখা হয়। তাকে শিক্ষকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় ক্ষোভ থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। এ ঘটনার সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
হত্যাকারীর বাড়িতে আগুন:
শিশু মুনতাহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত মার্জিয়ার বসতঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। গতকাল বিকেলে কানাইঘাটের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামে শিশু মুনতাহা হত্যাকারীদের বাড়িতে জড়ো হন এলাকাবাসী। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *