
বিশেষ প্রতিবেদক | সিবিটুয়েন্টিফোর নিউজ
কক্সবাজারের রামু থানার এক উপ-পরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে উঠেছে অবিশ্বাস্য এক অভিযোগ। অভিযোগটি এমন— ১৭ দিন আগের কোনও ঘটনা না ঘটলেও সেটিকেই দেখিয়ে সাদা পোশাকে তুলে এনে এক নিরীহ দোকানদারকে দস্যুতার মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে!
এই নাটকীয় অভিযানের মূল চরিত্র— রামু থানার এসআই আনোয়ার।
আর ভুক্তভোগী— কক্সবাজার শহরের তারাবনিয়ারছড়ার তরুণ দোকানদার আব্দুল মাবুদ সুজন, যিনি জীবিকার তাগিদে দীর্ঘদিন ধরে একটি ছোলা-মুড়ির দোকান চালান।
🔹 ঘটনার সূচনা: হঠাৎ সাদা পোশাকে ‘অভিযান’
১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে হঠাৎ করে কয়েকজন সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি এসে সুজনের দোকানে হাজির হয়।
তারা অভিযোগ তোলে— “তোমার কাছে চোরাই মোটরসাইকেল আছে।”
বিস্মিত সুজন প্রতিবাদ করলে, হাতকড়া পরাতে উদ্যত হয় তারা। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় রামু থানার এসআই আনোয়ারের নেতৃত্বে দলটি।
সেদিন রাতেই শুরু হয় আরেক রহস্য।
এসআই আনোয়ার কক্সবাজারের ঝিলংজার লারপাড়া এলাকা থেকে একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করে রামু থানায় নিয়ে আসেন। এরপর রাতভর লেখা হয় ‘দস্যুতার মামলা’।
আর বাদী করা হয়— চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার এক যুবক সজিব হোসেনকে, যিনি এসআই আনোয়ারের ভাগিনা!
🔹 মামলার তারিখে গরমিল ও রহস্য
সিবিটুয়েন্টিফোর নিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ তথ্য— মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে ২৩ আগস্ট ২০২৫ রামু থানাধীন জোয়ারিয়ানালা ইউপির ঘটনা। কিন্তু স্থানীয়দের কেউই সেদিন এমন কোনও ঘটনার কথা জানেন না।
অর্থাৎ, ঘটনার ১৭ দিন পর নিরীহ এক দোকানদারকে পুরনো তারিখে দেখিয়ে দস্যুতার মামলায় ফাঁসানো হয়।
🔹 পর্দার আড়ালে ইয়াবা লেনদেন!
তদন্তে জানা যায়— মামলার আসল পটভূমি ‘চোরাই মোটরসাইকেল’ নয়, বরং ইয়াবা ব্যবসার অভ্যন্তরীণ লেনদেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সজিব হোসেন (এসআই আনোয়ারের ভাগিনা) এবং এক যুবক হাদী ইয়াবা লেনদেনে জড়িত ছিল। হাদী এক পর্যায়ে মোটরসাইকেলটি জামানত হিসেবে রেখে দেয়। এই ঘটনাকে ‘দস্যুতা’ হিসেবে দেখিয়ে মামলা সাজানো হয় যাতে ইয়াবার লেনদেনের বিষয়টি আড়ালে রাখা যায়।
🔹 ভাগিনা-ভাগিনার ‘প্রীতির মামলা’!
তদন্তে উঠে আসে, এসআই আনোয়ার বহুদিন ধরে তার ভাগিনা সজিবের নানা অবৈধ কর্মকাণ্ডে প্রভাব খাটিয়ে সহযোগিতা করে আসছিলেন। যখন ইয়াবা লেনদেনে সমস্যা তৈরি হয়, তখন এসআই আনোয়ার বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে ঘুরিয়ে দিতে দস্যুতার মামলা দায়ের করেন। এমনকি তিনি ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন পর্যন্ত করেন আদালতে!
🔹 এসআই আনোয়ারের স্বীকারোক্তি!
সিবিটুয়েন্টিফোর নিউজ টিম কৌশলে এসআই আনোয়ারের সাথে যোগাযোগ করলে, তিনি নিজেই স্বীকার করেন—
“লারপাড়া থেকে মোটরসাইকেল উদ্ধারের সময় সুজন সেখানে ছিলেন না। পরে সিএনজি যোগে তাকে ঘটনাস্থলে আনা হয়।”
এই বক্তব্যের অডিও প্রমাণ সিবিটুয়েন্টিফোর নিউজের হাতে রয়েছে।
🔹 পুলিশের মধ্যেও আপত্তি
ঘটনার দিন এসআই আনোয়ার কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মিঠুনের সহযোগিতা চান মোটরসাইকেল উদ্ধারে।
কিন্তু এসআই মিঠুন জানান— “ঘটনাটি অর্থনৈতিক লেনদেনসংক্রান্ত জেনে আমি উদ্ধারে অংশ নিইনি।”
এমন বক্তব্যে পুরো মামলার উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
🔹 ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ
আব্দুল মাবুদ সুজনের বড় বোন শাহিনা আক্তার ইতোমধ্যে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। তিনি দাবি করেন— “আমার ভাই নির্দোষ। ভাগিনা-ভাগিনার সম্পর্ক রক্ষায় এক পুলিশ কর্মকর্তা তার ক্ষমতা ব্যবহার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার ভাইয়ের জীবন ধ্বংস করতে চাচ্ছেন।”
এই ঘটনাটি শুধু একটি ব্যক্তিকে নয়, পুরো পুলিশ প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
একজন নিরীহ নাগরিককে ‘দস্যু’ বানিয়ে ফেলার এই প্রবণতা রুখে না দিলে, আইনশৃঙ্খলার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে— এমনটাই মনে করছেন সচেতন মহল।
মন্তব্য করুন