যে যুগে নজরুলের জন্ম, সেই যুগে বড় একটি প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছিল ‘জাতি’ পরিচয়। আরও একটি শব্দের মোড়লিপনা ছিল, সেটি হলো ‘জাত’। নজরুল লিখেছেন, ‘জাতের নামে বজ্জাতি’। উৎসগত দিক থেকে ‘জাত’ ও ‘জাতি’ শব্দ দুটি সমসূত্রীয় হলেও তাদের প্রয়োগ ও দ্যোতনা এক নয়।
‘জাত’ বলতে খুব সহজেই বলা চলতো উঁচু জাত, নিচু জাত, অজাত, কুজাত; সঙ্গে রাখা যেত জাতপাতের সমস্যা। লালন যেমন বলেছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।’ ‘জাতি’ শব্দটি দিয়েও ‘জাত’ শব্দের কাজ চলে যেত। জাতের বিচার চলতো লৈঙ্গিক পরিচয় প্রসঙ্গেও—নারী জাতি, পুরুষ জাতি।
‘জাত’ ও ‘জাতি’ শব্দের আর্থপরিধি জুড়ে সক্রিয় থেকেছে মানুষের ধর্ম, বর্ণ ও পেশাগত পরিচয়। কিন্তু নতুন এক দ্যোতনা হাজির হয়েছে ‘জাতি’; একটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে বাঁধতে চেয়েছে ভাষিক, স্থানিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নতুন সুতায়। রাজনৈতিক মানদণ্ডে গড়ে ওঠা এই জনগোষ্ঠীর পরিচয়কে বলা হয়েছে ‘জাতি’ বা ‘নেশন’। চারদিকে যখন নেশনের তুমুল বিস্তার, তখন নজরুলের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? প্রশ্ন জাগে, নজরুলের ‘জাতি’ পরিচয় কী?
আপাতভাবে প্রশ্নটি মীমাংসিত বলেই ধরে নেওয়া হয়। যদিও বিভিন্ন কালপর্বে নজরুলকে জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন খোপে বন্দি করা হয়েছে। নজরুলের নির্বাক দশায় কিংবা মৃত্যুত্তর পটভূমিতে জাতি পরিচয়ের বিচিত্র রকমের উপস্থাপনা দেখা গেছে। পাকিস্তান আমলে তৈরি করা হয়েছে নজরুলের পাকিস্তানি সংস্করণ। জাতীয়তাবাদের সেই কুয়াশা কাটতে না কাটতেই নজরুল ঢুকে গেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি জাতীয় চেতনার প্রকোষ্ঠে; বিশেষভাবে তা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ কেন্দ্রিক।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে একই সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ দাশ। অনেকের মনে পড়বে, ১৯৭১ সালে লেখা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সেই বিখ্যাত গান—‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা / নজরুলের বাংলা দেশ / জীবনানন্দের রূপসী বাংলা / রূপের যে তার নেইকো শেষ।’ ‘হারানো বাংলা’কে খুঁজে পাওয়ার আন্তরপ্রেরণায় রচিত হয়েছিল এই গান। মজার ব্যাপার হলো, এই তিনজনই জাতীয়তাবাদের কঠোর সমালোচক। আবার এই তিনজনই জাতীয় চেতনার কৌম, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়কে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেননি।
পাকিস্তান আমলে তৈরি করা হয়েছে নজরুলের পাকিস্তানি সংস্করণ। জাতীয়তাবাদের সেই কুয়াশা কাটতে না কাটতেই নজরুল ঢুকে গেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি জাতীয় চেতনার প্রকোষ্ঠে; বিশেষভাবে তা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ কেন্দ্রিক।
কবিরা তাদের লেখায় আর জীবনচরিতে যা-ই বলুন না কেন, পরবর্তীকালের অনেক অনেক প্রজন্মের হাত ধরে সেইসব কথার নতুন প্রয়োগ ও পাঠ চলতেই থাকে। আর তাই বাংলা অঞ্চল ও ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক লড়াইয়ে নজরুলের জাতি পরিচয়-প্রসঙ্গ নতুনভাবে তোলাই যায়।
বিশেষত যখন জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায় বিষয়ক উগ্র মতবাদ মাঝেমধ্যেই হানা দিতে উদ্যত হচ্ছে। নজরুল সম্পর্কে বেশকিছু প্রসঙ্গের পুনর্পাঠ করা যেতে পারে। জাতি বলতে নজরুল কী বোঝাতেন? নজরুলের জাতীয় চেতনার স্বভাব কী? জাতি প্রসঙ্গের উপস্থাপনায় নজরুল একরৈখিক কোনো অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন কি না?
নজরুলের সাহিত্য থেকে উদ্ধার করা যাবে প্রচুরসংখ্যক বাক্যাংশ কিংবা শব্দ সমবায়—যেখানে তিনি ‘জাতি’, ‘জাতিগঠন’, ‘নেশন’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। ‘নবযুগ’ প্রবন্ধে পাশাপাশি রেখেছেন ‘জনগণ’, ‘দেশ’ ও ‘জাতি’; রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড, তুরস্কের বিপ্লবী ও জাতীয় জাগরণগুলো স্মরণ করেছেন এই প্রবন্ধে।
ঘুমন্ত ভারতবর্ষের জেগে ওঠা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘একই দুঃখে আজ দুঃখী জনগণ দেশ জাতি সমাজের বহির্বন্ধন ভুলিয়া পরস্পর পরস্পরকে বুকে ধরিয়া আলিঙ্গন করিল।’ আবার লিখেছেন, ‘আমাদের মধ্যে ধর্ম-বিদ্বেষ নাই, জাতি-বিদ্বেষ নাই, বর্ণ-বিদ্বেষ নাই, আভিজাত্য-অভিমান নাই।’ বিদ্বেষ না-থাকা মানে হলো বিদ্বেষ ছিল। আমরা ধরে নিতে পারি, বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে থাকাটাই নজরুলের কাম্য। কিন্তু কীভাবে?
নজরুল বলছেন জাতি গঠনের কথা। একেবারে সময় উপযোগী প্রসঙ্গ। ইউরোপের ইতিহাসে ততদিনে জাতিগঠন প্রক্রিয়া মোটামুটিভাবে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। নজরুল শুধু জাতি প্রসঙ্গেই থেমে থাকছেন না, বলছেন ‘মহাজাতি’র কথা। তিনি বুকে টেনে তুলতে চাইছেন ‘উপেক্ষিত জন-সঙ্ঘ’কে; নজরুল বলেন, ‘মানবতার এই মহা-যুগে একবার গণ্ডি কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বলো যে, তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমান নও, তুমি মানুষ—তুমি সত্য।’
ধর্ম, সম্প্রদায়, বর্ণ, শ্রেণিভেদ দূরে ঠেলে নজরুলের প্রসারিত কল্পনা জানান দেয়, ‘এই অভিমানীদিগকে বুক দিয়া ভাই বলিয়া পাশে দাঁড় করাইতে পারিলেই ভারতে মহাজাতির সৃষ্টি হইবে, নতুবা নয়।’ কিন্তু জাতির জন্য প্রয়োজন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য। সেটির প্রতিষ্ঠা কীভাবে ঘটবে—যদি না অন্তরমহল থেকে হিংসা, দ্বেষ, জাতিগত রেষারেষির ‘সাংঘাতিক বীজ’ অপসারিত না হয়।
জাতি ও জাতিগঠনের মতো আধুনিক ধারণার সামনে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর চিন্তা হিসেবে তখনো ভারতবর্ষে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল ‘ছুৎমার্গ’র ধারণা। নজরুলকে সেই বিষয়ে একটি প্রবন্ধও লিখতে হয়েছিল। একশো বছর আগের বাস্তবতা ছিল এরকম—মুসলমানকে স্পর্শ করলে স্নান করতে হয়, মুসলমান খাবার ছুঁয়ে দিলে তা অপবিত্র হয়, মুসলমানের পদস্পর্শ লাগা স্থান গোবর ছুঁইয়ে পবিত্র করতে হয়। জাতিগঠনের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত বাস্তবতা। অথচ রাজনীতির মঞ্চ-ময়দানে চলছে হিন্দু-মুসলমানের গলাগলি।
সত্যি কথা বলতে কি, ছদ্মভাবাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদ আড়াল-আবডালের সুদৃশ্য মোড়ক তৈরি করেই থাকে। নজরুলের তা পছন্দ হলো না। তিনি লিখলেন, ‘কি ভীষণ প্রতারণা! মিথ্যার কি বিশ্রী মোহজাল! এই দিয়া তুমি একটা অখণ্ড জাতি গড়িয়া তুলিবে?’ ওই প্রবন্ধেই শোনাচ্ছেন, ‘আমরাই ভারতে আবার অখণ্ড জাতি গড়িয়া তুলিব।’ ‘আবার’ শব্দটির প্রয়োগে খটকা লাগে, ভারতে কি অখণ্ড জাতি ছিল, যা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে? নাকি কবিসুলভ কল্পনা?
নজরুলের সাহিত্য থেকে উদ্ধার করা যাবে প্রচুরসংখ্যক বাক্যাংশ কিংবা শব্দ সমবায়—যেখানে তিনি ‘জাতি’, ‘জাতিগঠন’, ‘নেশন’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন।
নজরুলের এই উচ্চারণকে গ্রহণ করতে হবে কবিকল্পনা হিসেবে। কেননা ভারতে জাতিগঠন প্রক্রিয়া সম্পন্নই হয়নি। তবে প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল জাতি-কল্পনা। উনিশ শতকের বাংলায় সামষ্টিক কল্পনা হিসেবে গড়ে উঠছিল জাতির ধারণা। আর সেইসব কল্প-বৃত্তান্ত এমন হয়ে উঠত যে, মনে হতো ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল রাজনৈতিকভাবে অখণ্ড জাতি-পরিচয়ের অধীন।
মূলত রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের অতীত বিষয়ক অনুভব থেকে তৈরি হচ্ছিল অখণ্ড জাতির ধারণা। সমকালের বাতাবরণে থেকে নজরুলও সেই মতে সায় দিয়েছেন মাত্র। তবে অখণ্ড জাতি গঠনের কথা বললেও নজরুলের লেখার জাতির রঙ এক নয়, বহু হিন্দু জাতি, মুসলমান জাতি, বাঙালি জাতি; আর এরা সবাই বঙ্গ-জননী ও ভারত-মাতার সন্তান। নজরুলের জাতিচিন্তার এই পরিসর অনৈতিহাসিক নয়। সেই কালের রাজনীতির তাৎপর্য ও প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে জাতি বিষয়ক বয়ান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই আবার সেইসব চিন্তা ও বয়ানের মোড় ঘুরেছে।
লেখালেখির গোড়ার দিকে জাতি বলতে নজরুল বুঝেছেন, ‘দেশের অধিবাসী লইয়াই তো দেশ এবং ব্যক্তির সমষ্টিই তো জাতি।’ ব্যক্তি ও সমষ্টির ঐক্যকেই নজরুল বুঝেছেন জাতীয় ঐক্য। এই পর্বে দেশমাত্রই মাতৃপ্রতীকে মোড়া। দেশ মানেই ভারতমাতা। একদিকে আছে মায়ের ভুবনেশ্বরী মূর্তি, অন্যদিকে আছে মৃত্যুরূপা কালী। দেশ-উদ্ধার, দেশের কাজ মানেই হলো মায়ের সেবা করা।
ভারতীয় কংগ্রেসের কাজের ভেতর তিনি খুঁজে পেয়েছেন ‘শত শত জাতি সম্প্রদায়ের একীভূত মহামিলন’। তার প্রত্যাশা কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘সহস্র সহস্র হিন্দু, মুসলমান, জৈন, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পার্শি, আর্য, ব্রাহ্ম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নরনারী আমাদের ছিন্ন-ভিন্ন, উৎপীড়িত, লাঞ্ছিত, শত অত্যাচারে জর্জরিত, রোগ-শোক-প্রাপীড়িত, ভীত-ত্রস্ত তেত্রিশ কোটি মানবের জীবনমরণের সমস্যা, ইহজীবনের সুখ-দুঃখ আলোচনা করবার জন্যে সম্মিলিত হবেন।’ ‘ভাববার কথা’ প্রবন্ধে দেখা যাচ্ছে, ‘জাতি’ বলতে কোনো বিশেষ সম্প্রদায় কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করেননি।
একটু পরেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বুরোক্রেসির কসাইখানার ছোরা যতই ধারালো ও ভারী হোক না কেন, এবার দেখা গেল বাংলা তো তাতে কাটলই না, উপরন্তু ছোরা যেন চুম্বকশক্তিতে সারা ভারতের সমস্ত টুকরা কুড়িয়ে নিয়ে এসে সত্যি সত্যিই একটি জাতি গড়বার জন্যে ১৯০৬ সালে কলকাতার ময়দানের পাশে জমায়েত হলো। জাতীয় মহাসমিতির বীজ সেইবার অঙ্কুরিত হয়ে চারা বেরুল।’
জাতিগঠনের কেন্দ্রবীজ রূপে নজরুল এবার দেখতে চাইলেন বাঙালিকে। ঐতিহাসিক রূপরেখা হিসেব করে বললেন, ‘১৯০৭ সালে বাঙালির ছেলেরা তাদের স্বভাবসিদ্ধ কোমলতা ও উন্মাদনায় সারা ভারত জাগাল, ভারতজোড়া মহামারী কাণ্ড বেঁধে গেল। জাতীয় যজ্ঞের পৌরহিত্য তরুণের হাতে গিয়ে পড়ল।’ বাঙালির সক্রিয়তার ফলেই নজরুলের মনে হয়েছে ‘জাতীয় তরু এখন পুষ্পিত।’
বাঙালির নেতৃত্বে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী ভারতীয় জাতীয় চেতনায় উদ্দীপিত হলেও ঐক্যের বিন্দুতে কোথাও একটা সমস্যা থেকে গেছে। প্রতীকী প্রণোদনায় নজরুল লিখেছেন, ‘এইবার জাতির আর এক মহাসমস্যা উপস্থিত। মায়ের পূজার বিধান নিয়ে, ক্রম নিয়েই এই বিবাদ।’ নজরুল ইঙ্গিত করেছেন কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী রাজনীতির পদ্ধতিগত বিভাজনকে।
জাতিগঠনের আরেকটি বাধা ছিল শ্রেণিগত। মার্কসবাদ, রুশ বিপ্লব ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে ধারণা থাকায় নজরুলের পক্ষে জাতি পরিচয় তৈরিতে শ্রেণির প্রসঙ্গ বিবেচনা করা কঠিন কিছু ছিল না। শ্রেণিগত দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুল প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তোমাদের এই আভিজাত্য-গর্বিত, ভণ্ড, মিথ্যুক ভদ্র সম্প্রদায় দ্বারা—(যাহাদের অধিকাংশেরই দেশের জাতির প্রতি সত্যিকার ভালবাসা নাই) মনে করো কি দেশ-উদ্ধার হইবে, জাতিগঠন হইবে?’ জাতিগঠনের জাতপাত শুধু সমস্যা নয়, উচ্চবর্গের শোষণ ও দৃষ্টিভঙ্গিও একটি বড় সমস্যা। কিন্তু সেসব সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় চেতনা রাজনীতির শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আত্মরক্ষামূলক জাতীয় চেতনা নজরুলের সাহিত্যের নিয়ন্ত্রক দৃষ্টিভঙ্গিসমূহের একটি। এই কারণেই নজরুলের জাতীয় চেতনার আরেকটি বর্গ হয়ে উঠেছে মুসলমানের জাতীয় পরিচয়।
জীবনের এক পর্বে নজরুল হিন্দু ও মুসলমানকে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে দেখেছেন। মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধে তার এই দ্বিমাত্রিক জাতিচিন্তার পরিচয় মেলে। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটির অভিভাষণে বলেছেন, ‘ইংরেজের শাসন সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে এই যে, তার শিক্ষা-দীক্ষার চমক দিয়ে সে আমাদের এমনই চমকিত করে রেখেছে যে, আমাদের এই দুই জাতির কেউ কারুর শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতার মহিমার খবর রাখিনে।’
আরেকটি উদাহরণ হলো, ১৯৩৬ সালে ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্রসম্মিলনীতে অভিভাষণ দিতে গিয়ে নজরুল আরব, আফ্রিকা, মিশর, ইরান, স্পেন অঞ্চলে মুসলমানদের সাম্রাজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিস্তারের ইতিহাসকে তালিকাবদ্ধ করেছেন। শেষে মুসলমান তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘যুগে যুগে তোমরা এসেছ ভাবী নেশনের নিশানবরদার হয়ে।’ জাতির সমার্থক হিসেবে নজরুল ব্যবহার করেছেন ‘কওম’ শব্দটি। তাহলে কি নজরুলের জাতিচেতনার পটভূমি বদলে গেল? আদতে তা নয়। সংস্কৃতি, সম্প্রদায় ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে জাতি কল্পনা সেই কালের একটি সাধারণ প্রবণতা। সনাতনী আর্য সংস্কৃতি ও ধর্ম পরিচয়কে ধারণ করেও গড়ে উঠেছিল হিন্দু জাতির পরিচয়।
প্রকৃতপক্ষে হিন্দু-মুসলমানের বৈপরীত্যমূলক অবস্থান ও বাস্তবতায় নজরুলকে মুসলমান জাতি-কল্পনায় শামিল হতে হয়েছিল। মুসলমান সমাজের ভেতর নিহিত ছিল অনৈক্যের উপাদান, ছিল ইতিহাস চেতনা এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতি। নজরুল লিখেছেন, ‘যে ইখাওয়াৎ সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, যে একতা ছিল মুসলিমের আদর্শ, যার জোরে মুসলিম জাতি এক শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবী জয় করেছিল, আজ আমাদের সে একতা নেই…।’
নজরুল-প্রাসঙ্গিক এক স্মৃতিলেখায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র জানিয়েছেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক নজরুলকে ডেকেছিলেন তার দপ্তরে। নজরুল তখন দৈনিক নবযুগের সম্পাদক। ‘মুসলিম লীগ বাংলাকে ভাগ করে নিতে চায়’—ফজলুল হক এই বিষয়ে নজরুলের মত জানতে চান।
বিশ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানের একটি পরিচিতির প্রয়োজন ছিল। নজরুল সেই পরিচিতি নির্মাণে যোগ দিয়েছেন। পরিচয় গড়তে গিয়ে তাকে ভাবতে হয়েছে বাঙালি পরিচয়কেও। আর তাই তার চোখে ধরা দিয়েছে জাতি পরিচয়ের আরেক বর্গ ‘বাঙালি মুসলমান’।
১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে দেওয়া অভিভাষণে নজরুলের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল বাঙালি মুসলমানের চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা। এই অভিভাষণে নজরুল কথা বলেছেন বাঙালি মুসলমানের গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অবরোধপ্রথা, নারীশিক্ষা, সংঘচেতনা, সংগীত, শিল্প, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ইত্যাদি প্রসঙ্গে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান আলোচিত হয়েছে ‘জাতি’ হিসেবে। কট্টর মোল্লাদের প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘ইসলামের কল্যাণের নামে ইহারা যে কওমের, জাতির ধর্মের কী অনিষ্ট করিতেছেন, তাহা বুঝিবার মতো জ্ঞান নাই বলিয়াই ইহাদের ক্ষমা করা যায়।’
নজরুল তার শেষ পরিচয় দিয়েছিলেন ১৯৪২ সালে—‘বাঙালির বাংলা’ নামের প্রবন্ধে। শারীরিক ও মানসিকভাবে তখন তিনি স্তিমিত হয়ে এসেছেন; ‘বাঙালির বাংলা’ই সম্ভবত তার বিদ্রোহের শেষ শিখা। জাতিগত পরিচয়ের বহুমুখী টান তাকে আর তাড়িত করছে না। বাঙালিকেই তিনি চিহ্নিত করলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ভাগ্যবিধাতা।
জাতি-পরিচয়ের চূড়ান্ত রূপ তিনি দেখালেন এই প্রবন্ধে, “বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে ‘বাঙালির বাংলা’—সেইদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। সেইদিন একা বাঙালিই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে। বাঙালির মতো জ্ঞানশক্তি ও প্রেম-শক্তি… এশিয়ায় কেন, বুঝি পৃথিবীতে কোনো জাতির নেই।” খাঁটি জাতীয়তাবাদীর মতো করেই তিনি কল্পনা করলেন বাঙালির সোনালি অতীত, দেখালেন বাঙালির প্রকৃতি, সম্পদ ও সমৃদ্ধির বিস্তার। তবে কি নজরুল টেরে পেয়ে গিয়েছিলেন বাংলা ভাগ হয়ে যাচ্ছে?
নজরুল-প্রাসঙ্গিক এক স্মৃতিলেখায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র জানিয়েছেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক নজরুলকে ডেকেছিলেন তার দপ্তরে। নজরুল তখন দৈনিক নবযুগের সম্পাদক। ‘মুসলিম লীগ বাংলাকে ভাগ করে নিতে চায়’—ফজলুল হক এই বিষয়ে নজরুলের মত জানতে চান। নজরুল বললেন, ‘বাংলা দেশকে ভাগ করা মানে বাঙালী জাতকে ধ্বংস করে দেওয়া। আমি জানি না আপনার কি মত, আমি সর্বশক্তি দিয়ে এর বিরোধিতা করবো। বাঙালীর সভ্যতা, সংস্কৃতি শুধু হিন্দুরাও গড়ে নি, মুসলমানরাও গড়ে নি—এই দুই সম্প্রদায় একসঙ্গে বাঙালী জাতকে তৈরি করেছে—একে ভাগ করবেন কি ক’রে? একটা সাময়িক ধর্মীয় ব্যাপার টেনে এনে যদি তা করা হয়, তাহলে আমাদের সকলের যে কী সর্বনাশ হবে তা পরে বুঝবেন।’
১৯৪২ সালের এই স্মৃতিবয়ানের সঙ্গে পার্থক্য নেই ‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধের। কিন্তু ততদিনে চেতনার গভীর দেশে ‘সর্বনাশ’ হয়ে গেছে; তারই চোরাস্রোতে এসে গেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৪৭, বাংলা ভাগ, বাঙালি ভাগ। নজরুল প্রবন্ধটি শেষ করেছিলেন এই বলে, ‘বাংলা বাঙালির জয় হোক! বাংলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’ বাঙালি কি জিতেছে? নজরুলের জাতি-পরিচয় খোঁজার ঐতিহাসিক বৃত্তান্তের ভেতর দিয়ে ফিরে দেখা সম্ভব বাঙালির জয়-পরাজয়ের ইতিহাস।
সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়