মানবাধিকারের নামে প্রতারণাই দিলদারের পেশা!

delwar
print news

উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও প্রতারণা ও মানবপাচারসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করেনি ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ নামে একটি বেসরকারি সংগঠনের (এনজিও) মহাসচিব পদধারী সাইফুল ইসলাম দিলদার। ‘মানবাধিকার কর্মকর্তা’ সাজিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানবপাচার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থা ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের’ নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার অভিযোগে রবিবার (১১ জুন) তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। একইসঙ্গে তার সহযোগী হিসেবে আরও  ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়।

পুলিশ ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পক্ষ থেকেও ‘মানবাধিকার কর্মকর্তা’ ও ‘কর্মী’ হিসেবে ভিসা পাইয়ের দেওয়ার প্রতারণার বিষয়ে পুলিশকে অবহিত করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা কথিত মানবাধিকার সংগঠন ‘প্রোটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’- এর মহিউদ্দিন জুয়েল ও উজ্জল হোসাইন মুরাদসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার কমিশনের নামে জনগণের সঙ্গে  প্রতারণা ও অর্থ আদায় করছে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন নামের একটি বেআইনি সংস্থা। মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। ‘কমিশন আইন ২০০৯’ অনুসারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ আইনের ২ (ক) ধারা মতে ‘কমিশন’ অর্থ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। তবে ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের লোকজন তাদের সংস্থার নামের সঙ্গে ‘কমিশন’ শব্দটি ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছে তাদের সংগঠনকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা পরিচয় দিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে।

এছাড়া, কথিত ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ তার নামের শেষে ‘কমিশন’ শব্দটি এবং নামের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে ‘বিএইচআরসি’ শব্দটি ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং প্রিন্ট মিডিয়া কোথাও ব্যবহার করতে পারবে না বলে হাইকোর্ট রুল জারি করে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন। যা আপিল বিভাগও বহাল রাখে। ফলে কথিত ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ নামে কোনও কার্যক্রম চালালে তা অবৈধ হবে।

দিলদার গাড়িদিলদারের গাড়ি

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়,  কথিত ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ নামের  বেসরকারি সংগঠনের মহাসচিব সাইফুল ইসলাম দিলদার ও তার সহযোগীরা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করা এবং এর বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এছাড়া ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত বলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সদস্য সংগ্রহ, কমিটি গঠন, যুক্তরাজ্যে মানবাধিকার কনভেনশনের নামে মানবপাচার কাজে প্রলুব্ধ করাসহ নানা অপতৎপরতা চালিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করছে।

মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা স্বত্ত্বেও  তারা ক্রমাগত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইট (www.nhrc.org.bd) এর আদলে (www.bhrc.bd.org) ওয়েব সাইট তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। এতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

কথিত সংগঠনটির মহাসচিব সাইফুল ইসলাম দিলদার তাদের নিজস্ব ফেসবুক পেজ ও ওয়েব সাইটে ‘যুক্তরাজ্য মানবাধিকার কনভেনশন-২০২৩’ নামে একটি গণবিজ্ঞাপন প্রচার করে যুক্তরাজ্যে পাঠানো হবে বলেও লোক সংগ্রহ করছে। এছাড়া এই সংগঠনের সদস্যরা তাদের ব্যবহৃত গাড়িতে পতাকা স্ট্যান্ড ও বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত সোনালী রঙের প্রতীক ব্যবহার করে আসছে। ওই পতাকার ভেতরে প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ও সংক্ষেপে বিএইচআরসি শব্দ ব্যবহার করে নিজেদেরকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় মানবাধিকার কমিশন হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। সাইফুল ইসলাম দিলদার ও তাদের সহযোগীরা ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক প্রতারণার মাধ্যমে ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রতারণাপূর্বক মানবপাচারের উদ্দেশ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রেসিডেন্ট, মহাসচিব, সচিব হিসেবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। ওই বিজ্ঞাপন গত ৪ জুন (২০২৩) কমিশনের নজরে আসে।পরে মানবপাচার আইনের তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

অবৈধ চিঠিঅবৈধ চিঠি

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপ-পরিচালক এম রবিউল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কশিমনের’ নামে একটি এনজিও’র অনুমতি নেওয়া ছিল আগেই। ২০১২ সালে সমাজকল্যাণ অধিদফতর থেকে তাদের নামটি বদলাতে এবং  কমিশন শব্দটি ফেলে দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা কোনও তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো করেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। শুধু তাই নয়, আঞ্চলিক শাখা, গোয়েন্দা শাখার নামেও কর্মী সংগ্রহ করে অবৈধভাবে তাদের কাজকর্ম চালিয়ে আসছিল।’

তিনি জানান, ‘আগামী ৭ আগস্ট (২০২৩) যুক্তরাজ্যের লন্ডনে মানবাধিকার কনভেশন অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্য মানবাধিকার কনভেশন-২০২৩ এ যোগ দিন।’ এভাবে ভুয়া বিজ্ঞাপন প্রচারণা শুরু করে কথিত এই মানবাধিকার সংগঠনটি। আগ্রহী ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে তারা বলে, সেখানে যেতে হলে ‘একজন  মানবাধিকার কর্মীকে’ ১৫ লাখ টাকা করে  দিতে হবে। এভাবে ‘মানবাধিকার কর্মকর্তা’ সাজিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিদেশে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তারা মানবপাচারের একটি বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল।

রবিউল ইসলাম আরও  বলেন, ‘‘কথিত এই সংস্থার মহাসচিব সাইফুল ইসলাম দিলদার শুধু বাইরের মানুষের সঙ্গেই যে প্রতারণা করেছে তা নয়। সে তার নিজের ভাই-বোন ও স্বজনদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছে। নিজের ভাই-বোনদের পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে একাই ভোগ করছে। এ বিষযে তার ভাই-বোনেরাও তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। লেখাপড়া সামান্য হলেও দিলদার নামের আগে ‘ডক্টরেট’ শব্দটি ব্যবহার করে আসছে।’’

সূত্র-বাংলাট্রিবিউন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *