দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এখন মুখ্য আলোচনায়। আমেরিকা বাংলাদেশের কাছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ চায়। তারা সেখানে সামরিক ঘাঁটি করতে চায়। দক্ষিণ এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে নজরদারির স্বার্থে বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষমতাধর দেশটির এমন ইচ্ছা দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরো বেড়েছে। এ কারণে দ্বীপটি তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা নেয়ার পর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে শেখ হাসিনা সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে রাজনৈতিক মহলে।
জানা যায়,প্রতিবেশদূষণের কারণে বিপন্ন হয়ে ওঠায় বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে নিয়ে কয়েক বছর ধরেই সরব রয়েছেন পরিবেশবাদীরা। কিন্তু সম্প্রতি এ দ্বীপ নিয়ে আরও ব্যাপক আলোচনা চলছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলেএ আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে। গত ১৪ জুন জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য রাশেদ খান মেননের বক্তব্য থেকে। সেন্টমার্টিনের দিকে কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চোখ পড়েছে- তার এমন মন্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সময় রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন চায়, বাংলাদেশকে কোয়াডে চায়। এ কারণেই তাদের নতুন ভিসানীতি- যেটা রেজিম চেঞ্জের কৌশলের তাংশ। বর্তমান সরকারকে হটানোর লক্ষ্যে তারা সবকিছু করছে।’
২১জুন বুধবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে খোলাখুলি বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, সেন্টমার্টিন লিজ দিলে ক্ষমতায় থাকতে অসুবিধা নাই। কিন্তু তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা, তার দ্বারা এটা কিছুতেই হবে নাতিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এই দেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চাই না।’
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিশ্লেষকরা বলছেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূ- রাজনৈতিক অবস্থানই একে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কেবল বিপন্ন একটি প্রবাল দ্বীপ হওয়ার কারণে নয়, এই অবস্থানের কারণেই এ দ্বীপ বারবার আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোও এই দ্বীপকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ এটির অবস্থানই এমন যে, এখান থেকে এশিয়ার তিন গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি চীন, ভারত ও মিয়ানমারের ওপর নজরদারি করা সম্ভব। সেন্টমার্টিন দ্বীপের এই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এবং পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
কূটনৈতিক একটি সূত্র জানায়, দক্ষিণ এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে নজরদারির স্বার্থে বঙ্গোপসাগরের এই অংশে একটি নৌ সামরিক ঘাঁটি করতে গত প্রায় দুই দশক যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি ব্রিকস গঠনের মাধ্যমে ভারত ও চীনের মধ্যেকার নৈকট্যও আপাতদৃষ্টিতে বেড়েছে। এসব কারণে এ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করতে নানা কৌশল নিতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিনে প্রথমে একটি মেরিন একাডেমি স্থাপন করতে চাইছে। যেটিকে ঘিরে পরবর্তী সময়ে এই পরাশক্তিটির পক্ষে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি আরও সংগঠিত করা যাবে। এ দ্বীপে ঘাঁটি করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চীন ও ভারত দুই দেশকেই যেমন নজরদারিতে রাখা সম্ভব হবে, তেমনি প্রয়োজনে চোখ রাঙানোও সহজ হবে। অবশ্য এই মুহূর্তে রাঙানো চোখ নিয়ে নয়, মিষ্টি হাসির দৃষ্টি দিয়েই ভারতকে পাশে রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ভারতকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে চীনকে চাপের মুখে রাখতে চাইছে।
এরই মধ্যে মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেন্টমার্টিনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরও বেড়েছে। কারণ এখানে ঘাঁটি করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মিয়ানমারে চীন সমর্থিত সেনা সরকারকে বলয়ভুক্ত করা কিংবা চাপের মধ্যে রাখা সহজ হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ওয়াশিংটনের দিক থেকে এ নিয়ে এখনও প্রকাশ্যে কিছু বলা হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নানা কার্যক্রম ও পদক্ষেপ থেকে দেশের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা ডালপালা মেলছে। বিশেষত বাইডেন প্রশাসন থেকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রসঙ্গকে ধরে বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাজনৈতিক মহলেও এমন আলোচনা রয়েছে, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’ নিশ্চিত
করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি করেছেসেটিও সেন্টমার্টিনকে ‘নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কৌশল’। জাতীয় সংসদে রাশেদ খান মেননও সে কথাই বলেছেনএই কৌশল বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ধীরে চলো নীতি’। অবলম্বন করলেও সম্প্রতি খুব জোরেশোরে অগ্রসর হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একজন কূটনৈতিক বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপ পাওয়ার জন্যে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়নি। কিন্তু বিশ্ব-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে বিষয়টিকে সেরকমই ধারণা করা হচ্ছেতা ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচনে এটি একটা রাজনৈতিক ইস্যুও হয়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য থেকেও মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি সেদিকেই এগোচ্ছে।
জরিপ ও পর্যবেক্ষণ হয়েছে ১৯৯১ সালে প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের শেষ দিকেও ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপে নৌঘাঁটি স্থাপনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের শাসনামলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পর সেন্টমার্টিন দ্বীপে সহায়তা কার্যক্রমের পাশাপাশি নৌঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ এবং জরিপও করে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রসঙ্গত,বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অবস্থান। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ২৫০ বছর আগে আরব নাবিকরা এ দ্বীপে প্রথম বসবাস শুরু করেন। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে এ দ্বীপ টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা সমুদ্রের নিচে চলে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বর্তমান দক্ষিণ অংশটি জেগে ওঠে। এর ১০০ বছরের মধ্যে উত্তর অংশ এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে ওঠে।
ওঠে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় এ দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই সময় মিয়ানমার (বার্মা) ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল। তবে সেন্টমার্টিন দ্বীপটিকে বার্মার সঙ্গে যুক্ত না রেখে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর আগে ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে বর্মী রাজার সংঘটিত যুদ্ধের ইস্যুগুলোর মধ্যে এ দ্বীপের মালিকানাও ছিল অন্যতম।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় আট বর্গকিলোমিটার। সেন্টমার্টিন দ্বীপ-সংলগ্ন ছেঁড়া দ্বীপ মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল থেকে আট কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিতভাটার সময় দুটি দ্বীপ এক হলেও জোয়ারের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মিয়ানমার একাধিকবার তাদের মানচিত্রে সেন্টমার্টিনকে অন্তর্ভুক্ত করে দেখানোর অপকৌশল নেয়। তবে ঢাকার প্রবল প্রতিবাদের মুখে মিয়ানমার সেই মানচিত্র সংশোধন করে।