কক্সবাজারকে বলা হয় বাংলাদেশের পর্যটনের স্বর্গ। অনেকে আবার কক্সবাজারকে পর্যটনের রাজধানী নামেও অভিহিত করেন। সারাবিশ্বে কক্সবাজার বহুল আলোচিত, পরিচিত এক শহর। সবাই আলো ঝলমলে কক্সবাজারের সাথেই পরিচিত। কিন্তু প্রদীপের নীচে রয়েছে অন্ধকার। ট্রাভেল প্যারাডাইস কক্সবাজারেরও রয়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক কালো অধ্যায়। কক্সবাজারের এই অন্ধকার দিকের সাথে আমরা খুব একটা পরিচিত নয়। অন্ধকার এই দিকটি পর্যটন শহরের উজ্জ্বলতাকে কিছুটা হলেও ম্লান করেছে।
পর্যটন খাতে কক্সবাজারের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। প্রকৃতিও কক্সবাজারকে দিয়েছে বিশাল সম্ভার, নজরকাঁড়া সৌন্দর্য,নয়নাভিরাম রূপ-বৈচিত্র্য। একদিকে সবুজ পাহাড় ও অরণ্য,অন্যদিকে সমুদ্রের নীল জলরাশি। এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মুগ্ধতার যেন শেষ নেই। সৌন্দর্যের অন্বেষণে তাই তো হাজারো পর্যটক এখানে ভীড় করে প্রতিদিন।
কিন্তু এই শহরের নাগরিকরা খুব একটা ভাল নেই। কক্সবাজারে রয়েছে সহস্রাধিক হোটেল,মোটেল। হোটেল মোটেলে বিনিয়োগও হাজার কোটির উপরে। তবে নান্দনিক পর্যটন খাতে স্হানীয়দের খুব কমই নিয়োগ দেয়া হয়। ব্যবসায়ীগন মনে করেন চাকুরির ক্ষেত্রে অ-স্হানীয়রা নিরাপদ। ফলে স্হানীয় যুবকরা বেকারত্বের কষাঘাতে জর্জরিত। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে তারা আবার মাদক সেবন ও পাচার, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
পর্যটনের কারনে কক্সবাজার ইতিমধ্যে সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরের তকমা পেয়েছে। এখানে জমির দাম রীতিমতো আকাশচুম্বী। কক্সবাজার শহরে বা শহরতলীর নিকটে জমিক্রয় করা সাধারনের নাগালের বাইরে। তবে কালো টাকার মালিকদের কথা আলাদা। জমির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাড়িভাড়া। রোহিঙ্গারা আসার পর শত শত এনজিও কর্মীর কক্সবাজারে আগমন ঘটেছে। ফলে বাড়ীওয়ালাদের অবস্থা হয়েছে পোয়াবারো! একলাফে বাড়িভাড়া হয়েছে দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ। বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চলের চেয়ে কক্সবাজারে জমির দাম ও বাড়িভাড়া অস্বাভাবিক বেশি। তার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।
একসময় রোহিঙ্গাদের বরণ করার জন্য সারা দেশবাসী একাট্টা হয়েছিল। সরকার ও স্হানীয়রা উদারতা, মানবিকতা দেখাতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাজনীতির ঘেরাটোপে পা দিয়ে বসে। ফলে প্রায় দশ লক্ষের উপরে রোহিঙ্গা শরনার্থী বর্তমানে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই সকল রোহিঙ্গারা এখন কক্সবাজারের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। এরা জড়িয়ে পড়েছে নানামুখী অপরাধে। ফলে এখানে অনেকটা অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে হত্যা, গুম,অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ও ইয়াবার চোরাচালানের মত অপরাধ।
পর্যটন শহর হওয়ায় এখানে মাছ,মাংস,নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদাও ব্যাপক। কিন্তু যোগান সীমিত। যার কারনে এখানে কোন জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে না। সব পণ্যের দামই অনিয়ন্ত্রিত ও বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। বাড়তি দ্রব্যমুল্যের কারনে সাধারণ মানুষের অবস্থা অনেকটা নাকাল,অসহনীয় পর্যায়ে। দ্রব্যমুল্যের মহার্ঘের কারনে কক্সবাজারে সরকারি চাকুরীজীবিগনের জন্য রয়েছে পর্যটন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা। কিন্তু সাধারনের জন্য বাজার ব্যবস্হার ন্যুনতম তদারকিও নেই। ফলে জনগন নিষ্পেষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত পর্যটন ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে দিনের পর দিন।
একসময় কক্সবাজার শহর ছিল শান্তির শহর। সৌন্দর্যের শহর। দেশি বিদেশি পর্যটকে মুখরিত আশ্চর্য এক শহর। আর এখন এই শহর সন্ত্রাসী ও রোহিঙ্গা অপরাধীদের অভয়ারণ্যে। অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কিছু চিহ্নিত অপরাধী,কতিপয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক অল্পকিছু দুর্বৃত্ত ও এলাকাভেদে কতিপয় কিশোর গ্যাং এর হাতে। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা অপরাধের বাড়বাড়ন্ত অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী।। শহরের বেশ কিছু পয়েন্টে প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে ছিনতাই হয়। আর রাতের এই শহর যেন “ডাকাতদের গ্রাম”। জরুরি কাজে রাত বারটার পর বাড়ির বের হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আমি নিজেও রাতের বেলায় একদফা ছিনতাইয়ের কবলে পড়েছি। তবে রক্ষা পেয়েছি তাৎক্ষনিক বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের কারনে।
পর্যটনের বিকাশ হোক সবাই চায়। একই সাথে স্হানীয়দেরও জীবনের মানোন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অস্বাভাবিক বাড়িভাড়ার লাগাম টেনে সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। ভাড়াটিয়াদের উপর বাড়িওয়ালাদের জুলুম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জমি কেনাবেচায় অস্বাভাবিক রেজিষ্ট্রেশন ফি বাতিল করতে হবে। দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি রোধকল্পে নিয়মিত বাজার তদারকি করতে হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত চিরুনি অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে সাময়িক স্থগিত ক্রশফায়ার পুনরায় চালু করতে হবে। তবেই বাসযোগ্য হবে এই শহর।