টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নির্মাণাধীন দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের এক কিলোমিটারেরও বেশি অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে সরে গেছে রেললাইনের পাথর। ক্ষতি হয়েছে এমব্যাংকমেন্টের (রেল বা সড়কপথের জন্য মাটির বাঁধ)। এর প্রভাবে স্থানে স্থানে বেঁকে গেছে রেলপথটি। কোথাও কোথাও ডেবে গেছে। সব মিলিয়ে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখানো নিরূপণ করতে পারেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন শহর কক্সবাজারে যাওয়ার এ রেলপথ আগামী অক্টোবরে উদ্বোধনের কথা রয়েছে। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করে মেরামতকাজ শুরুর তাগিদ রয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এজন্য দু-একদিনের মধ্যে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করবেন বলে জানা গেছে।
রেলপথটির সাতকানিয়ার উত্তর ঢেমশা, দক্ষিণ ঢেমশাসহ স্থানে স্থানে ২০-৫০ মিটার পর্যন্ত অংশ বন্যার পানিতে ডুবে যায়। একই অবস্থা তৈরি হয় লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলার বিভিন্ন স্থানেও। এসব অংশে এরই মধ্যে পানি নেমে গেলেও রেললাইনের পাথর ও মাটি সরে গেছে। কিছু জায়গায় বেঁকে কিংবা সরে গেছে রেললাইনও। এর বাইরে প্রায় ১০০ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দোহাজারী থেকে চকরিয়া অংশে। চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের (সিআরইসি) সঙ্গে যৌথভাবে অংশটির কাজ বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন।
রেলপথটির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের পরিচালক বিমল সাহার সেলফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে প্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রজেক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আহমেদ সুফি বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, তাদের অংশে (চকরিয়া-কক্সবাজার) বন্যায় রেলপথটির বিভিন্ন জায়গায় পানি জমলেও কোথাও বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে টানা বৃষ্টিতে স্টেশন ভবনসহ চলমান বিভিন্ন কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যায় রেলপথটির কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এতে রেলওয়ের আর্থিকভাবে কোনো ক্ষতি হবে না। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নির্মাণাধীন ও নির্মাণ-পরবর্তী ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে রেলপথ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায় ঠিকাদারের। আর ঠিকাদারের যেহেতু বিষয়টি নিয়ে বীমা করা আছে, সেহেতু আমরা এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এতে ঠিকাদার ও বীমা কোম্পানির মধ্যে জটিলতা তৈরি হতে পারে। তবে নির্ধারিত সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশসহ পুরো রেলপথটির কাজ শেষ করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এজন্য রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন।’
রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, ‘১০০ বছরের মধ্যে ওই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে এবার। ভারি বৃষ্টিপাতের প্রভাবে নতুন রেলপথে কিছুটা ক্ষতি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। যেসব জায়গায় রেলপথ কিছুটা আঁকাবাঁকা ও উঁচু-নিচু হয়েছে, ওই স্থানগুলোয় রেলের পাতে জয়েন্ট দেয়ার কাজ এখনো শেষ হয়নি। জয়েন্ট না থাকার কারণেই মূলত এমনটা হয়েছে।’
এদিকে দোহাজারী-কক্সবাজারের মধ্যে তৈরি করা রেলপথটির কারণে ওই অঞ্চলে বন্যার পানি নেমে যেতে দেরি হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এমন প্রেক্ষাপটে রেলপথটির নকশায় পরিবর্তন আনার দাবিও তুলছেন কেউ কেউ। বিষয়টি নিয়ে ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি ঘুনধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের’ অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি যদিও বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নকশা পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। আগের নকশাতেই প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ শেষ করা হবে।’
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন ডুয়াল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত (ফার্স্ট ট্র্যাক) প্রকল্পগুলোর একটি। ২০১০ সালের ৬ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) এর অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ৪২ মাস। এ হিসাবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এর কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। যদিও পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটির মেয়াদ ৩০০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৬৮ মাসে উন্নীত করা হয়েছে। অন্যদিকে ৮৭৪ শতাংশ বাড়িয়ে রেলপথটির নির্মাণ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।