সরকারের রাজাকারের তালিকা করার উদ্যোগ থেমে গেছে। বাস্তব জটিল পরিস্থিতি বিবেচনায় এ তালিকাটি আর হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখনও বলা হচ্ছে, রাজাকারের তালিকা করা থেকে তারা সরে আসেননি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্যরা জানিয়েছেন, প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল সেটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় করা হয়েছিল। কিন্তু চরম বিতর্কের মুখে সেটি স্থগিত করা হয়েছিল। এত বছর পর এখন নতুন করে রাজাকারের তালিকা হলে নানাভাবে সেখানে নিরপরাধ মানুষের নাম ঢুকে যেতে পারে, বাদও পারতে পারে প্রকৃত কোনো রাজাকারের নাম। এছাড়া কে রাজাকার ছিল কে ছিল না- এত বছর পর সেটি চিহ্নিত করা খুবই দুরূহ একটি কাজ। এছাড়া মাঠ-পর্যায়ে রাজনৈতিক ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বের শিকার হতে পারেন কেউ কেউ। এ পরিস্থিতিতে রাজাকারের নতুন তালিকা আরও বড় বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাই নতুন তালিকায় আগ্রহ নেই সরকারের। যদিও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এবার স্বাধীনতা দিবসের মধ্যে রাজাকারের তালিকা চূড়ান্ত করার কথা জানিয়েছিলেন। এ অবস্থায় রাজাকারের তালিকা করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের সাধারণভাবে রাজাকার বলা হয়। পাকিস্তানিদের সহযোগী আরও দুটি সংস্থার নাম ছিল আলবদর ও আলশামস। পাকিস্তানিদের নানা অপকর্ম যেমন- হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন তারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর এত বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের তালিকা করা হয়নি।
‘রাজাকারের তালিকা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি শাহজাহান খানকে (বর্তমানে সদস্য) প্রধান করে একটা কমিটি করা হয়েছিল। আমি যতটুকু জানি তারা এখন পর্যন্ত কোনো তালিকা আমাদের দেননি। তাই এ বিষয়ে অগ্রগতি তার কাছ থেকে জেনে নিন।’— মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী
২০১৯ সালে ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে ঘোষিত তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুসহ রাজশাহীর আরও দুই ব্যক্তির নাম রয়েছে ওই তালিকায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এ নিয়ে সারাদেশে সমালোচনা শুরু হয়।
বিতর্কের মুখে রাজাকারের তালিকা স্থগিত করে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইট থেকে তালিকাটি সরিয়ে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
পরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর মন্ত্রিসভা বৈঠকের অনুমোদন, জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর গত ৭ সেপ্টেম্বর নতুন ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২’ জারি করা হয়।
এর আগে রাজাকারের তালিকা করতে শাজাহান খানের নেতৃত্বে সংসদীয় সাব-কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ২০২২ সালের এপ্রিলে সেই কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত সাব কমিটিতেও শাজাহান খান আহ্বায়ক হন। এর অন্য দুই সদস্য ছিলেন- জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও আওয়ামী লীগের বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি শাহজাহান খানকে (বর্তমানে সদস্য) প্রধান করে একটা কমিটি করে দেওয়া হয়েছিল। আমি যতটুকু জানি তারা এখন পর্যন্ত কোনো তালিকা আমাদের দেননি। তাই এ বিষয়ে অগ্রগতি তার কাছ থেকে জেনে নিন।’
‘নতুন রাজাকারের তালিকা করা খুবই কঠিন। তবে অসম্ভব না। তবে সেজন্য আমাদের অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে, কোথাও কোথাও রাজাকারও নাকি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে।’— শাজাহান খান
তবে কী তালিকা হবে না- এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা হবে না, আমি সেটা বলছি না। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা আমাদের এখনো তালিকা দেননি।’
এ বিষয়ে শাজাহান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর দেড় শতাধিক উপজেলার তালিকা একটা করেছি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন এলাকার কমান্ডার, সরকারি বিভিন্ন অফিসের সহযোগিতা নিয়েছি। মোটামুটি একটা দাঁড় করানো হয়েছে। এরপর আমরা আর যেতে পারিনি। আংশিক তালিকা দিলে একটা বিতর্ক উঠতে পারে। সম্পূর্ণ তালিকা দিলেও সেটা হবে। আমরা কি বার বার সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখোমুখি হবো? আমরা কী পুরো তালিকা প্রকাশ করবো, নাকি ধাপে ধাপে করবো- সেটা নিয়ে সময়ক্ষেপণ করছি।’
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকার) এ সদস্য বলেন, ‘মন্ত্রীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তিনি বলেছেন তালিকা একসঙ্গে দিতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু একগুলো উপজেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন কাজ। এজন্য আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট পাওয়া কঠিন এত বছর পর। এটা নিয়ে প্রশ্ন যখন এসেছে, আমাদের হাতে যা আছে আমরা মন্ত্রণালয়কে দিয়ে দেবো।’
সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আরও বলেন, ‘নতুন রাজাকারের তালিকা করা খুবই কঠিন। তবে অসম্ভব না। তবে সেজন্য আমাদের অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে, কোথাও কোথাও রাজাকারও নাকি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে।’
নতুন করে অন্যান্য উপজেলা বিবেচনায় এনে রাজাকারের তালিকা করবেন কি না- জানতে চাইলে শাজাহান খান বলেন, ‘সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে মতবিনিময় করার ইচ্ছা আছে আমাদের। কারণ এটা নিয়ে তো বিতর্ক হবে। তবে আমাদের কাছে কিছু অথেনটিক বিষয় আছে। তবে এত বছর পর এ কাজটা কঠিন। পরবর্তী সময়ে আলোচনায় যে সিদ্ধান্ত হবে, সেই অনুযায়ী আমরা পদক্ষেপ নেবো।’
তবে নাম প্রকাশ না করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা লাগে না। দেশবাসী মানলে আমরা তালিকা এখনই দিয়ে দেবো। আমাদের কাছে তালিকা আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৯৭১ সালের রক্ষিত তালিকা আছে, কেউ তো তা মানে না। এখন তালিকা বানালে সেটা ফ্যাব্রিকেটেড হতে পারে। আজকে আমি যদি তালিকা তৈরি করি তাহলে আপনাকে আমি অপছন্দ করি আপনার নাম রাজাকারের তালিকায় দিয়ে দেবো। আমরা কেউ বড় রাজাকার ছিল, কিন্তু উনি আমরা ভগ্নিপতি, তালিকা থেকে সে বাদ।’
তিনি আরও বলেন, ‘তালিকা চান কেন? চাইলে ১৯৭১ সালেরটা চান। বলেন, ১৯৭১ সালের কি আছে দেন। আমরা তো সেটা প্রকাশ করেছি। কিন্তু আমাদের তো ক্ষমা চেয়ে সেটা প্রত্যাহার করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ডকুমেন্ট তো আপনারা মানছেন না। একাত্তরের তালিকায় তৎকালীন ডিসি, এসডিওর স্বাক্ষর করা তালিকা।’
‘সেখানেও অনেক বিষয় আছে। কেউ হয়তো সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি, কিন্তু নাম লিখে দিছে। পরে দেখা গেল তারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কেউ জীবন বাঁচানোর জন্য নাম লিখে দিয়েছে। আবার কেউ পাকিস্তানিদের সহায়তার জন্য নাম দিয়েছে তালিকায়’ বলেন ওই কর্মকর্তা।