আদিকাল থেকেই মানুষের মধ্যে নিজের তথ্য গোপন রাখার প্রবণতা রয়েছে। লেখালিখি যখন থেকে শুরু, এনক্রিপশন চর্চাও তখন থেকেই। হিসেব সহজ। একজন বার্তা পাঠাবে, অন্যজন তা গ্রহণ করবে।মাঝে কেউ সেই তথ্য খুঁজে পেলেও যেন বুঝতে না পারে।
এনক্রিপশন হলো এমন এক পদ্ধতি যেখানে মূল তথ্য বা উপাত্ত একটা সংকেত বা কোডে পাল্টে দেওয়া হয়। যাতে অন্য কেউ সেটা বুঝতে না পারে। এনক্রিপশনের অনেক পদ্ধতি আছে।
ধরা যাক, C অক্ষরকে B দিয়ে বদলে দেওয়া হলো। তাহলে CAT শব্দটি হয়ে যাবে BAT। এটা একটা সাইফার পদ্ধতি।
সাইফারের অনেক সূত্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ— অক্ষরকে তিন ঘর এগিয়ে একক্রিপ্ট করা। এটাকে শিফটিং বলে। যেমন H-এর জায়গায় বসানো হলো তিন ঘর পরের অক্ষর K।
অর্থাৎ HELLO হয়ে গেল KHOOR।
কিন্তু এই পদ্ধতিগুলো খুব দুর্বল। সহজেই ভাঙা যায় এসব সূত্র। তাই এনক্রিপ্টররা অক্ষর ছেড়ে ধরলেন গণিত। সূত্র, ফাংশন, বাইনারি সবই কাজে লাগালেন। কিন্তু শক্তিশালী পদ্ধতি পাওয়া দুষ্কর।
সমাধান দিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। বাইনারি সংখ্যায় দুটো বিট রয়েছে। ০ এবং ১। ধরুন আপনি কাউকে Hi লিখে বার্তা পাঠালেন। কম্পিউটারে তা ০১০০১০০০ ০১১০১০০১ কোডে বদলে যাবে।
গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর আগেই যদি কেউ কোডটা দেখে ফেলে সে সহজেই বুঝে যাবে এখানে Hi লেখা আছে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ঘটে মজার ঘটনা। ০ এবং ১ দুটো একইসঙ্গে দুই অবস্থায় থাকতে পারে। অর্থাৎ ০ বিট ১ রূপে থাকতে পারে আবার ১ বিট ০ রূপেও থাকতে পারে। একে বলে কিউবিট।
কিউবিটের কোড দেখে বোঝার উপায় নেই এটি কোন তথ্য বহন করছে। কেবল বিশেষ এক চাবি দিয়েই কিউবিটের কোড ডিকোড করা সম্ভব।
আলোর সমাবর্তন ধর্ম ব্যবহার করে তৈরি হয় এই চাবি। যা থাকে শুধু প্রেরক ও গ্রাহকের হাতে। সে চাবি দিয়ে তালা খুলতেও লাগে দুজনের সমর্থন। এই পদ্ধতির নাম কোয়ান্টাম এনক্রিপশন। তথ্য সুরক্ষার সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ এটি। যার ধারণা দেন চার্লস বেনেট এবং জিল ব্রাসার্ড।
কোয়ান্টাম কণিকাগুলো মূলত বিজড়িত বা ‘এন্ট্যাঙ্গলড’ কণা। সেগুলো একই সঙ্গে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে। এই বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে তথ্য সুরক্ষার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারটি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।
অ্যান্টন জাইলিঙ্গার। কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট নিয়ে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্টদের একজন। ২০০৪ সালে তিনি একটি অসাধারণ পরীক্ষা পরিচালনা করেন।
শহরের মেয়র ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০০ মার্কিন ডলার অনুদান দেন। ব্যাঙ্ক অস্ট্রিয়ায় ছিল মেয়রের অ্যকাউন্ট। অ্যান্টন জাইলিঙ্গার ব্যাংক অস্ট্রিয়া এবং সিটি হলের দুটো কম্পিউটার অপটিকাল ফাইবার দিয়ে সংযুক্ত করেন। দুই ভবনের দূরত্ব ৫০০ মিটার।
প্রথমে সিটি হলে বসে একটা ফোটনে ‘এনক্রিপশন কি’ তৈরি করেন তিনি। তাতে মেয়রের অ্যাকাউন্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে ৩০০০ ডলার পাঠানোর জন্য একটা সুরক্ষিত বার্তা ছিল। এরপর বিশেষ লেজারের মাধ্যমে ফোটন কণাটি ভেঙে দুটো ‘এন্ট্যাঙ্গলড’ ফোটন তৈরি করে একটি ফোটন পাঠিয়ে দেন ব্যাংকে।
ব্যাংক সফলভাবে সেই বার্তাটি গ্রহণ করে এবং তথ্যটি ডিক্রিপ্ট করে। অ্যান্টন জাইলিঙ্গার সবার সম্মতিতেই পরীক্ষাটি করেছিলেন। তিনি প্রমাণ করেন, কোয়ান্টাম ধর্ম ব্যবহার করেও সুরক্ষিতভাবে বার্তা পাঠানো সম্ভব। এ পদ্ধতিতে গ্রাহক ছাড়া অন্য কেউই ‘এনক্রিপশন কী’ ব্যবহার করে তথ্য ডিক্রিপ্ট করতে পারে না। এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার জন্যই ২০২২ সালে অ্যান্টন জাইলিঙ্গার নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।