রাত তখন ২টা। রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের সামনের সড়ক অবরোধ করে তখনো বিক্ষোভ করছিলেন অর্ধশত আহত ব্যক্তি। বিক্ষোভস্থল থেকে সামান্য দূরে রাতের নিস্তব্ধ সড়কে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিল ছয় তরুণ। সামনে এগিয়ে গেলে দেখা গেল, বসার স্থানের মাঝখানে মশার কয়েল জ্বালিয়ে ওরা ছয়জন মিলে মোবাইল ফোনে খেলছে ফ্রি ফায়ার গেম।
প্রত্যেকের পাশে রাখা ক্রাচ। ক্রাচ দেখে চোখ যায় ওদের পায়ের দিকে। তখন থমকে যেতে হয়। এই ছয়জনের প্রত্যেকের একটি করে পা নেই।কিন্তু তাদের প্রাণবন্ত আড্ডা দেখে বোঝার উপায় নেই, গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে এরা প্রত্যেকে একটি করে পা হারিয়ে বর্তমানে বরণ করে নিয়েছে প্রতিবন্ধীজীবন।
এদের প্রত্যেকের ঠিকানা ভিন্ন, পেশাও তা-ই। তবে তাদের দুঃখ-কষ্টগুলো একরেখায় মিলে গেছে। পা হারিয়ে এই তরুণরা এখন সংসারের বোঝা হয়ে উঠেছে।পা হারানো ছয় তরুণের মধ্যে তামীম ও মিরাজুল শিক্ষার্থী। নাদিম কাজ করত কাপড়ের দোকানে। রাকিব কাজ শেখা শুরু করেছিল সেলুনে, আর আকাশ কাজ করত মিষ্টির দোকানে। এই পাঁচ তরুণের বয়স ২০ বছরের কাছাকাছি। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অটোচালক রাজু।
তাঁর বয়স ৩৫ বছর। রাজুর উপার্জনে চলত স্ত্রী-সন্তানসহ চারজনের সংসার। আন্দোলনের সময় পা হারিয়ে রাজু এখন পরিবার নিয়ে মহাবিপাকে।
আন্দোলনে আহতরা গত বুধবার রাতে যখন নিটোর ও চক্ষু ইনস্টিটিউটের মাঝখানের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিলেন তখন এই ছয়জনও হাসপাতাল ছেড়ে সড়কে নেমে আসে। তারা জানায়, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আহত ব্যক্তিদের এক লাখ করে টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তারা পায়নি। চিকিৎসার খরচ বেশির ভাগ বহন করছে পরিবার। ফলে অধিকার আদায়ে তারাও একসঙ্গে সড়কে নেমে এসেছে।
ওদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই-আগস্টের সংঘর্ষ-সহিংসতার সময় গুলিতে তারা প্রত্যেকে পা হারিয়েছে। হাসপাতালের একই ওয়ার্ডে দীর্ঘদিন চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি নেওয়া, কৃত্রিম পায়ের প্রশিক্ষণ নিতে নিতে তারা একে অন্যের বন্ধু হয়ে উঠেছে।
তামীম, নাদিম, রাকিব ও রাজু বর্তমানে মোহাম্মদপুরের একটি এনজিওর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে থাকে। সেখানে কৃত্রিম পা দিয়ে হাঁটাচলা শেখানো হচ্ছে। মেরাজুল ও আকাশ প্রশিক্ষণ শেষে আগেই বাড়ি ফিরে গেছে। বুধবার এসেছিল চিকিৎসার জন্য। আন্দোলন দেখে আর বাড়ি যায়নি।
তারা জানায়, কৃত্রিম পা লাগানোর পর এখন হাঁটাচলা করতে পারে। কিন্তু আগের মতো আর কাজ করতে পারে না। তবে প্রশিক্ষণ শেষে তারা নিয়মিত কাজে ফিরতে পারবে এমন আশা করছে।
বন্ধুত্ব নিয়ে আকাশ বলে, ‘গত ৫ জুলাইয়ের পর আমাদের জীবন বদলে গেছে। একজন সুস্থ মানুষ থেকে আমরা এখন আলাদা। মানুষ আমাদের যে এখন ভিন্ন চোখে দেখে তার যে কষ্ট, সেটা বোঝানো সহজ নয়। কিন্তু এখানে আমরা সবাই এক। মূলত এ কারণ থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।’
আকাশের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। চার ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়। মিষ্টির দোকানে কাজ করে যা উপার্জন করত তা দিয়ে চলত পরিবার। পরিবারের প্রয়োজনে আরেকটু বেশি উপার্জন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল সৌদি আরব যাওয়ার। গত ২১ জুলাই সহিংসতা চলাকালে পুলিশের গুলিতে তার বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে যায়। সেই সঙ্গে ভেঙে যায় তার জীবনের স্বপ্নও। কারণ পরে চিকিৎসা চলাকালে জীবন বাঁচাতে তার এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে।
তামীম ও মিরাজুলের গল্পও একই। পরিবারকে না জানিয়ে মিছিলে অংশ নিয়েছিল তারা। মিছিল কিছুদূর এগোতেই সহিংসতা বাধলে তারা গুলিতে আহত হয়। তামীম মা-বাবার সঙ্গে থাকত মিরপুর-২ এলাকায়। পড়াশোনা করত অষ্টম শ্রেণিতে। মিরাজুলের বাড়ি পাবনায়। গত ৪ আগস্ট সদরের লতিফ টাওয়ার ট্রাফিক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয় সে। তার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করার।
নাদিম কাজ করত কাপড়ের দোকানে। তার বাবা অত্যন্ত অসুস্থ। চিটাগাং রোডের ওই দোকানে কাজে যাওয়ার পথে গুলিতে আহত হয় সে। নাদিম বলে, ‘আব্বা রিকশা চালায়। এখন আর পারে না। আমি মাসে যেটুকু বেতন পেতাম তা দিয়ে সংসার চলত। এখন আব্বা আবার রিকশা চালায়। আমি বেকার। কী করব জানি না!’