সিবি২৪
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩২ অপরাহ্ন
অনলাইন সংস্করণ

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যেন এক মৃত্যুফাঁদ

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে প্রায় প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে একদিকে যেমন প্রাণহানি ঘটছে, পঙ্গু হচ্ছে শত শত মানুষ। একমাত্র গত ৭ দিনে এই মহাসড়কে চারটি দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ছয়জনের; আহত হয়েছেন শতাধিক।

১৪৮ কিলোমিটারের এই সড়কটি বেশিরভাগ জায়গায় ১৮ থেকে ২২ ফুট প্রশস্ত। অপ্রশস্ত সড়ক, বিভাজক না থাকা ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে জানুয়ারি থেকে আগষ্ট পর্যন্ত আট মাসে ৬৫টি দুর্ঘটনায় ৯৮ জন নিহত হয়েছেন; ২৫৬ জন আহত হয়েছেন।

হাইওয়ে পুলিশ, চালক, বিআরটিএ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে ঢাকা পোস্ট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপ্রশস্ত সড়ক, ঝুঁকিপূণ বাঁক, বিভাজক না থাকা ও অনিয়ন্ত্রিত গতির কারণ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সড়কটি মাত্র দুই লেনের। দুপাশে গাছের কারণে ও কিছু বাঁকে সামান্য দূরে দেখা যায় না। যার কারণে নিয়ন্ত্রণ হারায় অথবা মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ ছাড়া ডিভাইডার না থাকায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। মহাসড়কে অবৈধ থ্রি হুইলার চলাচল ও সড়কের পাশাপাশি বাজারে রাস্তা পারাপারে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে। এ ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত গতিও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অভাবে এতোগুলো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাই আমরা এটিকে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলবো না, বলবো সরকারি হত্যাকাণ্ড।
মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মহাসচিব, যাত্রী কল্যাণ সমিতি
সড়ক প্রশস্তকরণ, সড়ক বিভাজক স্থাপন ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক কমিয়ে আনলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করছেন এই শিক্ষক।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের গুরুত্ব কোনো অংশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চেয়ে কম নয়। পর্যটন খাত বিবেচনায় সড়কটি চার লেন আরও অনেক আগে করা দরকার ছিল। পাশাপাশি দুপাশে সার্ভিস লাইন করা দরকার। তবুও সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অভাবে এতোগুলো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাই আমরা এটিকে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলবো না, বলবো সরকারি হত্যাকাণ্ড।’

অপ্রশস্ত সড়ক ও বিভাজক না থাকা
১৪৮ কিলোমিটারের এই সড়কটি অতিক্রম করতে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টা লেগে যায়। অথচ প্রায় ৩শ কিলোমিটারের ঢাকা-চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগে ৬ থেকে সাড়ে ৬ ঘণ্টা। অপ্রশস্ত সড়কের কারণে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, আবার জীবন দিয়েও খেসারত দিতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক বিভাজক না থাকায় ওভারটেকিং করতে চায় চালকেরা। এতে বিপরীতমুখী পরিবহনের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটছে।

হানিফ পরিবহনের চালক আবু ছালেক বলেন, মহাসড়কে স্বাভাবিকভাবে গাড়ির গতি একটু বেশি থাকে। এক্ষেত্রে সড়ক ছোট হওয়ায় দুর্ঘটনা বেশি হয়। সড়ক বড় থাকলে ইমার্জেন্সি ব্রেক করে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। এখানে এমন কিছু মোড় আছে ৪০-৫০ ফুট সামনে কী সেটা ঠিক মতো বোঝা যায় না। চালকদের সচেতনতা দরকার। তবে এর চেয়ে বেশি দরকার সড়কটি বড় করা।

বুয়েট শিক্ষক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সড়কটির বিভিন্ন অংশে হাটবাজার রয়েছে। সেখানে অনেকে অসাবধানে পারাপার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সড়কের মাঝে বিভাজক থাকলে পথচারী সেখানে দাঁড়াতে পারে, তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন; ফলে ঝুঁকিটা কমে আসে। বিভাজক না থাকলে পুরো সড়কটি একবারে পার হতে হয়, ওই সময়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েন পথচারীরা। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়।

আমরা যারা নিয়মিত এই রুটে গাড়ি চালাই, তারা সতর্ক থাকি। কিন্তু ট্যুরিস্ট নিয়ে যেসব গাড়ি বাইরে থেকে আসে, সেসব গাড়ির চালক এখানে অভ্যস্ত না।
আমির হোসেন, বাসচালক
ঘন ঘন ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক
এই বছরের এপ্রিলের শুরুতে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় চুনতির জাঙ্গালিয়া এলাকায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়। ওই এলাকার উঁচু-নিচু সড়কে বাঁকগুলো খুব বিপজ্জনক। বারবার দুর্ঘটনা ঘটায় সেখানকার সড়ক সংস্কার ও প্রশস্ত করার দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।

জাঙ্গালিয়ার এ অংশে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ঢালু পাহাড়ি সড়ক। এর মধ্যে কয়েকটি বিপজ্জনক বাঁক আছে। সারা বছরই সড়কের এ অংশে দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটির অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে মহাসড়কের হাশমতের দোকান, ঠাকুরদীঘি, উপজেলার পদুয়া, লোহাগাড়া শহর, আধুনগর, হাজি রাস্তা, চুনতি, জাঙ্গালিয়া এলাকা, চকরিয়া অংশের ইসলাম নগর ইমাম বুখারী মাদ্রাসা এলাকা, বানিয়ারছড়া ওরি আমগাছ তলা, হারবাং লালব্রীজ এলাকা আজিজ নগর, চকরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এলাকা, লক্ষ্যারচর জিদ্দা বাজার টার্নিং পয়েন্ট, মালুমঘাটের রিংভং ছগিরশাহকাটা ঢালা, ডুলাহাজারার পাগলিরবিল, খুটাখালী জাতীয় উদ্যান, নাপিত খালী, রামু রাবার বাগান।

শীতের সময় এই সড়কে বাড়তি বিপদ যোগ করে কুয়াশা। তবে বারো মাসই এই সড়ক বিপজ্জনক হয়ে থাকে লবণের পানি পড়ে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে। অতিরিক্ত গতি থাকলেই লবণের পানির কারণে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় চালকদের।

দূরপাল্লার বাসচালক মো. কাশেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, লবণের পানি ও ভোরের কুয়াসায় ভয়ংকর পিচ্ছিল থাকে এই সড়ক। তখন ব্রেক করলেও কাজ হয় না৷ তখন বিপদের আশঙ্কা বাড়ে।

দুর্ঘটনার জন্য চালকের চোখে ঘুমও অন্যতম কারণ বলে মনে করেন কাশেম। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে মাঝরাতে রওয়ানা করতে হয়। এই অংশে আসতে আসতে ভোর হয়ে যায়। তখন চালকের চোখে ঘুম আসে। চালকেরাও তো মানুষ। সবাই যখন বাসায় ঘুমায়, তখন আমাদের গাড়ি চালাতে হয়। রাতে না ঘুমিয়ে একটা মানুষ কতক্ষণ জেগে থাকতে পারে। তখন এদিক-সেদিক হলেই ঘটে দুর্ঘটনা।

অনিয়ন্ত্রিত গতি ও নিষিদ্ধ যানবাহন
১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে পটিয়া হাসানদণ্ডি এলাকায় বাস-সিএনজি মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩ জনের মৃত্যু হয়। ১৭ এপ্রিল চকরিয়া বানিয়ারছড়া এলাকা বাস সিএনজি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলে দুজনের মৃত্যু হয়। প্রায়সময় সিএনজির দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর আসে। অথচ মহাসড়কে থ্রি হুইলার নিষিদ্ধ।

বিআরটিএ-এর মোটরযানের গতিসীমা নির্দেশিকা-২০২৪ অনুয়ায়ী, বাংলাদেশে মহাসড়ক ও এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেট কার ও বাসের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার, মোটরসাইকেলের জন্য ৬০ কিলোমিটার এবং পণ্যবাহী যানের গতিসীমা ৫০ কিলোমিটার। কক্সবাজার মহাসড়কে অধিকাংশ চালক এই নির্দেশনা মানেন না বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।

গতিসীমা না মানা মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন দোহাজারী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহবুব আলম। তিনি বলেন, ‘এই মহাসড়কে যতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে, অন্য কোনো সড়কে নেই। এবং মহাসড়ক হিসেবে এটি একেবারেই অপ্রশস্ত। যতদিন এটি চার লেন ও সড়ক সোজা করা হবে না, ততদিন দুর্ঘটনা কমবে না।’

হাইওয়ে পুলিশ বলছে, এই সড়কে যারা অভ্যস্ত নয় বা নতুন চালকেরা বাঁকগুলো বুঝতে পারেন না। ফলে নতুন চালকদের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বেশি হয়।

মার্শা পরিবহনের চালক আমির হোসেন বলেন, ‘আমরা যারা নিয়মিত এই রুটে গাড়ি চালাই, তারা সতর্ক থাকি। কিন্তু ট্যুরিস্ট নিয়ে যেসব গাড়ি বাইরে থেকে আসে, সেসব গাড়ির চালক এখানে অভ্যস্ত না। ঈদের সময় যে ১৫ জন মারা গেছে, ওসব গাড়ির চালকদের কেউ না কেউ বাইরের ছিল।’

মহাসড়কের সঙ্গে বিভিন্ন সংযোগ সড়ক থেকে ছোট ছোট গাড়ি মহাসড়কে চলে আসে, তখন হেরফের হলেই বিপদে পড়তে হয় দূরপাল্লার চালকদের।

Facebook Comments Box

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছাড়া পেল কক্সবাজারের ঈদগড়ের দুই যুবক

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি আসলে ‘হামাসকে পুরস্কার’ দেওয়া: ট্রাম্প

আ.লীগের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করলেন ডাকসু ভিপি

ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে: প্রধান উপদেষ্টা

২১ মাসে দেশের ভেতরে ১৮ ভূমিকম্প, কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ?

এনসিপির মার্কা শাপলাই হতে হবে, অন্য কোনো অপশন নেই: সারজিস

বিএনপির কাছে কত আসন চেয়েছে জামায়াত, জানালেন মির্জা ফখরুল

যে ডলার আছে সেটা বাংলাদেশের আপৎকালীন সময়ের জন্য পর্যাপ্ত না

দগ্ধ ফায়ার কর্মীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন

১০

রাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো চলছে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’

১১

পুলিশের জন্য কয়েকশ কোটি টাকায় ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা আনা হবে: অর্থ উপদেষ্টা

১২

চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে দুটি হল নির্মাণের প্রস্তাব ডাকসুর

১৩

অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে: ধর্ম উপদেষ্টা

১৪

ড. ইউনূসের সফর ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে মুখোমুখি বিএনপি-আওয়ামী লীগ

১৫

২০ দিন পেছালো রাকসু নির্বাচন

১৬

গাজার জন্য শান্তিরক্ষী বাহিনীর প্রস্তাব ফ্রান্সের

১৭

আগামী নির্বাচনে ১৫০ আসন পাবে এনসিপি: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

১৮

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যেন এক মৃত্যুফাঁদ

১৯

পিআর দাবি পূরণ না হলে জামায়াত কি ভোট থেকে সরে দাঁড়াবে?

২০