দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়নে চার বছর আগে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। এখন পর্যন্ত সেই মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে পর্যটনশিল্প বিকাশে কাজ শুরু করা যায়নি। অপার সম্ভাবনার এ খাতটি রীতিমতো ধুঁকছে। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটার মতো পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে হচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। বিদেশি পর্যটকও বাড়ছে না আশানুরূপ। তবে সব সমস্যা কাটিয়ে শিগগির মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত হবে বলে আশা পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর।
পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজে জড়িত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়হীনতায় ৩০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনা আলোর মুখ দেখছে না। ফলে পর্যটন এলাকাগুলোতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে। দ্রুত সরকারকে পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ ও টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নে মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।
তবে মহাপরিকল্পনা তৈরিতে সংশ্লিষ্টরা জানান, পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত। এখন এ মহাপরিকল্পনায় কোনো ভুল-ত্রুটি আছে কি না, তা দেখা হচ্ছে। ঠিক কবে চূড়ান্ত করা হবে, তা কেউ বলতে পারেননি।
জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সম্প্রতি জাগো নিউজকে বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন চূড়ান্ত করার কথা ছিল। ওই সময়ে মহাপরিকল্পনার প্রায় সব কাজই গোছানো হয়। বই আকারে তা ছাপানো হয়েছে। শিগগির তা চূড়ান্ত করা হবে। তখন ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের পর্যটন নতুন যুগে প্রবেশ করবে। দেশের পর্যটন খাতে ঘটবে বিপ্লব।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের জুনে বিদেশি পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবালের সঙ্গে মহাপরিকল্পনা তৈরির চুক্তি করে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। এ চুক্তি অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন শুরু হয়। ওই বছরের ৩০ জুন তা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে কাজটি আটকে যায়। পরে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু ডিসেম্বরের মধ্যেও এ মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। অথচ এখন পর্যন্ত ভ্যাট ও এআইটিসহ এ প্রকল্পে প্রায় ২৮ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে।
ট্যুরিজম বোর্ড ও আইপিই গ্লোবাল জানায়, স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি- এই তিন ভাগে মহাপরিকল্পনাটি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে বিশ্লেষণ করা হবে দেশের পর্যটন শিল্পের বর্তমান অবস্থা, এর শক্তি কতটুকু, দুর্বলতা কোথায়, সম্ভাবনা কেমন, কোন ধরনের সংকট রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করা হবে বাংলাদেশের পর্যটনের ভিশন, মিশন, স্ট্র্যাটেজিক অবজেক্টিভস, প্রায়োরিটিস এবং লিংকেজ। তৃতীয় পর্যায়ে জোন বা এরিয়া নির্দিষ্ট করে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হবে। প্রোডাক্ট উন্নয়নের পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও বিনিয়োগের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করে কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত এবং বিপণন ও প্রমোশনাল কৌশল নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া মেলা, ফেস্টিভ্যাল, কার্নিভাল, কালচারাল অনুষ্ঠান, ব্র্যান্ডিং, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা, ভিডিও নির্মাণ, ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রদর্শনী ও ওশান ট্যুরিজমকে বেসরকারি উদ্যোগে চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের জাগো নিউজকে বলেন, করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন কারণে যথাসময়ে পর্যটন মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে পর্যটনের বিকাশে আমরা বসে নেই। যে তিনটি ধাপে (স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি) মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে, তারই অংশ হিসেবে টাঙ্গুয়ার হাওর, পদ্মা সেতু, সুন্দরবনের শরণখোলা, নওগাঁর পাহাড়পুর, নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ এলাকা পর্যটনবান্ধব করতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা ডিপিপি তৈরির প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। এভাবে দেশের অন্য পর্যটন এলাকাগুলোতে কাজ করবো।
এ মহাপরিকল্পনা তৈরিতে যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। সংস্থাটির একটি সূত্র জানায়, ৩০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনায় অবকাঠামো উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষা, বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে এ মহাপরিকল্পনা দেশের পর্যটন বিকাশে ঠিক কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।
তবে শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন পর্যটন বিকাশে সুফল বয়ে আনবে না বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দেশে পর্যটনের বহু জায়গা রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে পর্যটন কখনই অগ্রাধিকার পায় না। এজন্য পর্যটনবান্ধব মহাপরিকল্পনার বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা নেপাল পর্যটনকে সবচেয়ে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমাদের এখানে পর্যটন কখনই অগ্রাধিকার পায় না। বিদেশি পর্যটক আসার ক্ষেত্রে ভিসা জটিলতা একটি বড় সমস্যা। বিদেশি পর্যটক আসার ব্যাপারে আমরা এখনো উদার হতে পারছি না। বেশিরভাগ দেশ এখন ই-ভিসা, অন অ্যারাইভাল ভিসা দিচ্ছে কিন্তু আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিসা দিতে চাই না।
‘বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে দেশের মানুষের আচরণের পরিবর্তন অপরিহার্য। এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, যা পর্যটন মহাপরিকল্পনায় থাকতে হবে।’