ঘন কুয়াশায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণে নিয়মিত বিঘ্ন ঘটছে। অনেক ফ্লাইট ঢাকার আকাশে চক্কর মেরে নামছে দেশের অন্য বিমানবন্দরে। অনেক সময় পাশের দেশ ভারতেও ফ্লাইট চলে যাচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো। আর এমন বিপর্যয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ছেন যাত্রীরা।
এ সমস্যা দূর করতে ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) আপগ্রেডেশনের যে কাজ তা চলছে ধীরগতিতে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ভূমিকা নিয়েও।
দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর ও যাত্রীদের অভিযোগ, প্রতি বছর শীতের মৌসুমে ঘন কুয়াশার কারণে ফ্লাইট অবতরণ-উড্ডয়নে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। এতে ঢাকার ফ্লাইট সিলেট বা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নিয়ে অবতরণ করতে হচ্ছে। আবার দেশে খুব বেশি কুয়াশা থাকলে ফ্লাইট নামছে ভারত কিংবা মিয়ানমারের বিভিন্ন বিমানবন্দরে। তখন সংশ্লিষ্ট ওইসব বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে ফি হিসেবে দিতে হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। আবার যাত্রীদের সময় নষ্টও হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ জটিলতা নিরসনে দ্রুত শাহজালাল বিমানবন্দরে ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস-২) স্থাপনের কাজ শেষ করতে হবে।
আইএলএস হলো উড়োজাহাজ রানওয়েতে নিখুঁতভাবে অবতরণে সহায়তার জন্য স্থাপিত একটি পদ্ধতি, যেখানে বৈমানিকদের ভূমিতে অবতরণের জন্য উল্লম্ব ও অনুভূমিক দিকনির্দেশনা দিতে ভিন্ন ভিন্ন দুটি বেতার তরঙ্গ একযোগে ব্যবহার করা হয়। এখন উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিমানবন্দরে আইএলএস ক্যাটাগরি-৩ ব্যবহার করা হয়। সেখানে বাংলাদেশে এতেদিনেও আইএলএস ক্যাটাগরি-২ চালু করতে পারেনি বেবিচক।
বেবিচকের প্রকৌশল দপ্তরের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, উড়োজাহাজ অবতরণ করার ন্যূনতম দৃষ্টিসীমা ৫০০ মিটার। আইএলএস ক্যাটাগরি-২ থাকলে এ সুবিধা পান বৈমানিকেরা। তবে অনেক সময় ঘন কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা ৫০ থেকে শূন্য মিটারে নেমে আসে। সে সময় উড়োজাহাজ অবতরণে প্রয়োজন হয় ক্যাটাগরি-৩ সুবিধা। রানওয়েতে আইএলএস ক্যাটাগরি-৩ বসানো হলে শতভাগ দৃষ্টিসীমার সুযোগ পান বৈমানিকেরা।
সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের আকাশ প্রায়ই কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। সে সময় দৃষ্টিগোচরতা কম থাকায় রাতের বেলায় শাহজালালে উড়োজাহাজ অবতরণে সমস্যায় পড়তে হয় বৈমানিকদের। মাঝেমধ্যে কুয়াশা বেড়ে গেলে কখনো কখনো রাত থেকে দুপুরের আগ পর্যন্ত উড়োজাহাজ অবতরণ বন্ধ রাখতে হয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। এ সময়ে শিডিউলে থাকা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোও বিলম্বিত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে শাহজালাল বিমানবন্দরে আইএলএস থাকলেও সেটি এখনো সনাতনী ক্যাটাগরি-১-এর। তবে ২০২২ সালে আইএলএস-২ স্থাপনের কাজ শুরু করেছিল বেবিচক। যা এখনো শেষ হয়নি।
তিন মাসের কাজ এক বছরেও হয়নি: ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে যখন কুয়াশার কারণে ফ্লাইট ওঠানামা ব্যাহত হচ্ছিল, তখন তিন মাসের মধ্যে আইএলএস-২ আপগ্রেডেশন প্রকল্পটির কাজ শেষ করার আশ্বাস দিয়েছিলেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ মফিদুর রহমান। কিন্তু এরপর পুরো এক বছর পার হলেও এখনো পুরোপুরি চালু করা যায়নি আইএলএস-২। ফলে এবারও ঘন কুয়াশায় ব্যাহত হচ্ছে উড়োজাহাজ ওঠানামা।
গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে শাহজালাল বিমানবন্দরে দীর্ঘ প্রায় সাত ঘণ্টা ফ্লাইট অবতরণ বন্ধ ছিল। ওইদিন দুটি ফ্লাইট ঢাকার আকাশে চক্কর দিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর আগে গত ১১ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ৮টি ফ্লাইট ঢাকায় নামতে না পেরে কলকাতায় অবতরণ করে। এছাড়া দুটি ফ্লাইট কুয়ালালামপুর, একটি দিল্লি ও একটি ব্যাংককে গিয়ে নামে।
গত ৩১ ডিসেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ঘন কুয়াশার কারণে ৩০ ডিসেম্বর দিনৈগত রাত ১২টা থেকে ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৭টটা পর্যন্ত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুটি যাত্রীবাহী বিমান ফ্লাইট ডাইভার্ট হয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পরে সকাল আটটায় ডাইভার্ট ফ্লাইটগুলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসা শুরু করে।
এরপর গত ২ জানুয়ারি ঘন কুয়াশায় শাহজালাল বিমানবন্দরে দীর্ঘ সাড়ে ৮ ঘণ্টা উড়োজাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়। এসময় বিমানবন্দরে আসা ৬টি ফ্লাইট ঢাকায় নামতে না পেরে সিলেট ও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পরে ৪ জানুয়ারি ঘন কুয়াশার কারণে শাহজালাল বিমানবন্দরে নামতে না পেরে ১৩টি ফ্লাইট ভারতের কলকাতা, হায়দারাবাদ, চট্টগ্রাম ও সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। পরে ফ্লাইটগুলো ডাইভার্ট হয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসে।
এরমধ্যে সবশেষ গত ৪ জানুয়ারি ভোরে কুয়ালালামপুর থেকে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ঢাকার আকাশে চক্কর দিয়ে ঘন কুয়াশার কারণে নামতে না পেরে কলকাতায় গিয়ে অবতরণ করে। ফ্লাইটি তিন ঘণ্টা পর আবার ঢাকায় আসে।
ওই ফ্লাইটে যাত্রী ছিলেন কুমিল্লার চান্দিনার মনোয়ার হোসেন। আলাপকালে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, শাহজালালে বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে সরকার। কিন্তু ঘন কুয়াশার মধ্যে বিমান কীভাবে অবতরণ বা উড্ডয়ন করবে তার ব্যবস্থা তারা এতদিনেও করেনি। অথচ প্রতি বছর শীতে ওঠানামা করতে না পেরে দেশের অন্য বিমানবন্দর, এমনকি দেশের বাইরে গিয়েও অবতরণ করছে বিভিন্ন ফ্লাইট। এতে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি হচ্ছে।
জানতে চাইলে বেবিচকের সদস্য (এটিএম) এয়ার কমোডর মো. রিয়াদ হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, গত ৯ জানুয়ারি শাহজালালে আইএলএস-১ এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন সেখানে আইএলএস-২ এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মার্চ থেকে আইএলএস-২ এর পুরোপুরি সুবিধা পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিমানবন্দরের আইএলএস ক্যাটাগরি-২-এ উন্নতির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন শাহজালাল বিমানবন্দরে যত দ্রুত সম্ভব আইএলএস-২ এর সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। তবে গত পাঁচ-ছয় দিন শাহজালালে কোনো ফ্লাইট অবতরণ বা উড্ডয়নে সমস্যা হতে দেখা যায়নি।