বলপ্রয়োগে পুলিশ লিথ্যাল (প্রাণঘাতী) অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না। অপ্রাণঘাতী অস্ত্র, সাউন্ড গ্রেনেড, জলকামান, কাঁদানে গ্যাসের শেল দিয়ে দাঙ্গা দমন বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এমন সুপারিশ করবে পুলিশ সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে পুলিশ কমিশন গঠন ও পুলিশকে রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার সুপারিশ করা হবে। থাকছে কর্মসময় ৮ ঘণ্টা করা ও প্রারম্ভিক দুটি পদে (কনস্টেবল ও এএসপি) নিয়োগের সুপারিশ। সংস্কার কমিশনের একাধিক সদস্য কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে উচ্চাভিলাষী পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি অংশ বলপ্রয়োগে মারাত্মক অপেশাদার আচরণ করে। দাঙ্গা, রাজনৈতিক সমাবেশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চায়নিজ রাইফেলের (সিআর) মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। প্রাণঘাতী গুলি ছোড়া হয় হেলিকপ্টার থেকে। এতে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক দলের নেতা অনেকে গোপনে দেশ ছাড়েন। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য বলেন, বলপ্রয়োগে পুলিশ যেসব লিথ্যাল ওয়েপন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহার করে থাকে, সেগুলো আইনের কোন কোন ধারা বলে ব্যবহার করছে সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সে ধারাগুলো সংশোধন বা বাতিলের সুপারিশ করা হবে। যে কোনো বিক্ষোভ দমনে যাতে প্রাণহানি ও জখম এড়ানো যায়, সেজন্য ননলিথ্যাল ওয়েপন ব্যবহারের বিষয়ে জোর দেওয়া হবে।
ওই সদস্য আরও বলেন, সুপারিশে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়টি থাকবে। তারা সরকার ও পুলিশের মধ্যে সমন্বয়ক বা সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। তার মতে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্মমতা প্রদর্শন, গুম এবং বিরোধী মত দমনে পুলিশকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গত ১৫ বছরের বাস্তবতা খুবই ভয়াবহ ছিল। এর ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো পুলিশ বাহিনী মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। দেশের পুলিশি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকার্যকর ও ভেঙে পড়ে। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানোত্তর প্রেক্ষাপটে পুলিশকে পেশাদার ও জনমুখী সেবাদানকারী সংস্থায় পরিণত করতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই পুলিশ সংস্কার কমিশন একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের সুপারিশ করবে।
এর আগে ২০০৭ ও ২০১৩ সালে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকায় সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার যাতে বিষয়টি বাস্তবায়ন করে এবং কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে, সে বিষয়ে সুপারিশ করবে।
কমিশনের অন্য এক সদস্য বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে রেখে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশ যাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে, আমরা সে বিষয়ে সুপারিশ করব। এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কমিশন সদস্যদের সভাতেও বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
আরেকজন সদস্য বলেন, কনস্টেবল, উপপরিদর্শক (এসআই) ও সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এই তিনটি প্রারম্ভিক পদে পুলিশে সব নিয়োগ হয়। নিম্ন পদে যারা নিয়োগ পান, তাদের অনেকে যোগ্য হলেও উচ্চ পদে যেতে পারেন না। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কার করে তিনটি ধাপের বদলে প্রারম্ভিক নিয়োগের দুটি ধাপ চালুর বিষয়েও সুপারিশ করবে সংস্কার কমিশন। এক্ষেত্রে শুধু কনস্টেবল ও এএসপি পদ থাকার সুপারিশ করা হতে পারে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেয়। ওই সময় দেশে সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে পুলিশ বাহিনী। পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। ওই অবস্থায় জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করে। গত ৩ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কমিশনের প্রধান হিসেবে সাবেক সিনিয়র সচিব সফর রাজ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল, সাবেক বিভাগীয় কমিশনার ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শেখ মো. সাজ্জাত আলী (বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার), পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মো. গোলাম রসুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, মানবাধিকারকর্মী এ এস এম নাসিরউদ্দিন এলান এবং একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি। কমিশনকে ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিশন দায়িত্ব নিয়ে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়েছে এবং বেশ কিছু সভা করেছে। কমিশন বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে সর্বসাধারণের মতামত নিয়েছে।
কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেন, আমরা বেশ কিছু সভা করেছি। প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনের সঙ্গে বসে সুপারিশ করেছি। আমরা ৬ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করেছি। ৩১ ডিসেম্বর কমিশনের রিপোর্ট দাখিল করার কথা রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছু কাজ করেছি। এটাকে একটা খসড়ার চূড়ান্ত রূপও বলা যায়।
তিনি আরও বলেন, আমরা উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে বলেছি সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চাকরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই তুলে দিতে। বর্তমানে আধাসরকারি কিংবা ব্যাংকের চাকরির জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন করতে হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশনের এ পদ্ধতি ৯৬ বছর থেকে চলে আসছে। ব্রিটিশ আইনের ম্যানুয়াল অনুযায়ী এখানে কয়েক ধরনের প্রশ্ন এবং তদন্ত করা হয়। এতে অনেক সময় অনেক যোগ্য চাকরিপ্রার্থী বাদ পড়ে যান। দ্বিতীয়ত, আরেকটি বিষয় প্রচলিত আছে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কেউ রাজনীতি করে কি না এবং রাষ্ট্রবিরোধী কেউ আছে কি না। এটা ব্রিটিশদের আঙ্গিকে চিন্তা করা হতো। সম্প্রতি এমন অনেক অভিযোগ এসেছে, কারও আত্মীয়স্বজন রাজনীতি করে; কিন্তু সরকারি দল করে না, তাদের অনেকের ক্ষেত্রে এসব যুক্তি দেখিয়ে চাকরি দেওয়া হয়নি। এতে অনেক যোগ্য প্রার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
কমিশনপ্রধান বলেন, আমরা যেসব সুপারিশ করব সেগুলোর কিছু বিষয় স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ ছাড়া কিছু কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হবে। কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সরকারি আইন ও বিধিবিধান পাল্টাতে হবে। আমরা সেগুলো খতিয়ে দেখছি।