ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন আছে। দেশে এ বছর কোন ধরনটির প্রাদুর্ভাব বেশি, তার কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। অর্থের অভাবে স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু পরিস্থিতির ওপর নজরদারি করতে পারছে না।
স্বাস্থ্য বিভাগের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দেশের রোগ পরিস্থিতির ওপর নজরদারি করে। গত বছরও প্রতিষ্ঠানটি বলেছিল, ডেঙ্গুর কোন ধরনের (ভেরিয়েন্ট) কারণে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু গতকাল রোববার আইইডিসিআরের সম্মেলনকক্ষে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যবিষয়ক ‘ওয়ান হেলথ কনফারেন্স’ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেছেন, এ বছর ডেঙ্গুর কোন ধরনটির প্রাদুর্ভাব চলছে, তা তাঁদের জানা নেই। ডেঙ্গুর ওপর নজরদারি করার কার্যক্রম ‘ফান্ডের’ অভাবে বন্ধ আছে।
এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। অথচ অর্থের অভাবে আইইডিসিআরের নজরদারি কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার ঘটনাকে দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোগতাত্ত্বিক ঝুঁকি বোঝার জন্য ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে জানা দরকার। দ্বিতীয়ত চিকিৎসার প্রয়োজনেও ডেঙ্গুর ধরন জানা দরকার।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ ১২টি জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মশা নিধন ও রোগনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে। জেলাগুলোর মধ্যে আছে: চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, খুলনা, নড়াইল, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, বরগুনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও রংপুর। এসব জেলার একাধিক সিভিল সার্জন প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে বলেছেন, তাঁরা এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন।
ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা বেশি দেখা দেয়।
ডেঙ্গুর ধরন কখন বিপজ্জনক
রোগতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন হলো ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। একটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, অর্থাৎ শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে। ওই ধরনে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। তবে অন্য তিনটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলেছেন, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের অর্থ হলো ভিন্ন ধরনে আক্রান্ত হওয়া। অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা বেশি দেখা দেয়।
গত বছর ডেঙ্গুর কোন ধরনে আক্রান্ত কত রোগী ছিল, সেই তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক একরামুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৯০ শতাংশ ছিল ডেন-৩–এ আক্রান্ত, ৯ শতাংশ ছিল ডেন-৪–এ আক্রান্ত।
গত শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ডেঙ্গু নিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ‘শক সিনড্রোম’ বেশি দেখা যাচ্ছে।
আইইডিসিআরের ডেঙ্গু নজরদারি কর্মকাণ্ড বন্ধ সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল মহাপরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা (আইইডিসিআর) চাইলে আমরা ফান্ডের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতাম।’
রোগতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন হলো ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। একটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, অর্থাৎ শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে। ওই ধরনে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। তবে অন্য তিনটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে
গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১১ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫৪৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই সময়ে দেশে ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যু হয়নি। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১১ জুন (গতকাল) পর্যন্ত সারা দেশে ৩ হাজার ২১০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর মারা গেছেন ২৪ জন। এর মধ্যে গতকাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮৯ জন। মারা গেছেন ২ জন। পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু বেড়ে যেতে পারে বলে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহীর সিভিল সার্জনরা।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আয়াছুর রহমান বলেন, সামনে বর্ষা আসছে। শহরের নালা–নর্দমাগুলো ভরাট রয়েছে। এগুলো দ্রুত পরিষ্কার করা দরকার। ছাদের পানি, ফুলের টবের পানি, নারকেলের খোসায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার হয় কম। যেকোনো মুহূর্তে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারে।
চাঁদপুরের সিভিল সার্জন মো. শাহাদাত হোসাইন বলেন, চাঁদপুরে দিন দিন ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। কারণ, ঢাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মানুষ চাঁদপুরে আসছে। চাঁদপুরের অনেকে ঢাকায় বিভিন্ন পেশাজীবী হিসেবে কাজ করেন। অন্যদিকে রাজশাহীর সিভিল সার্জন আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, কোরবানি ঈদের সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ রাজশাহী আসবে। তখন ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু বেড়ে যেতে পারে বলে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহীর সিভিল সার্জনরা।
মশা নিধন হচ্ছে না
এডিস মশা ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়ায়। দেশের প্রায় সব জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মশা জরিপ হলেও অন্যান্য শহরের ক্ষেত্রে এমন তথ্য পাননি প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা।
প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বরগুনা শহরে মশা নিধনে কোনো কার্যক্রম নেই, চট্টগ্রামে মশার ওষুধ ছিটানো হয় অনিয়মিতভাবে, যশোরে মশা মারার দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। কুষ্টিয়া শহরের কয়েকটি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা বলেছেন, মশা মারার কোনো কার্যক্রম তাঁদের চোখে পড়ে না। চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, বরগুনা ও যশোর শহরে মশার উপদ্রব আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকা হাসপাতালে ডেঙ্গু ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে। সে কারণে ডেঙ্গু ওয়ার্ড আলাদা করার এবং সেই ওয়ার্ডে মশারি ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, রংপুরের সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ওয়ার্ড দেখা যায়নি। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য মশারি ব্যবহার করতে দেখা গেছে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, খুলনা, নড়াইল, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, বরগুনার হাসপাতালে।
ঢাকার দুই সিটিতে কী হচ্ছে
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনে এ বছর এ পর্যন্ত ২ হাজার ৪১২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দেশে এ বছর যে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে ২০ জনই দুই সিটি করপোরেশনের কোনো না কোনো হাসপাতালে মারা গেছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মশককর্মী আছেন ৮৮০ জন। তাঁরা পালা করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে দৈনিক মশা মারার কাজ করেন। ২৯ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশকনিধন কর্মসূচি চালায় উত্তর সিটি।
এর বাইরে উত্তর সিটিতে প্রশিক্ষণ পাওয়া ২৫০ জন বিএনসিসি ও ৩০০ জন রোভার স্কাউট বাসায় বাসায় গিয়ে সচেতনতার কাজ করছেন। তাঁরা ঢাকার ১০টি এলাকায় কাজ করেন। ৪ জুন মসজিদের ইমামদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে ১ হাজার ২০০ ইমাম অংশ নেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মহাখালী করোনা হাসপাতাল আছে। তাতে এখন কোনো করোনা রোগী নেই। সেই হাসপাতালের অর্ধেক শয্যা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসেন।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১ হাজার ৫০ জন মশককর্মী আছেন। প্রতিটি ওয়ার্ডে সকাল ও বিকেলে ১৪ জন করে কাজ করেন। গত মে মাসে ২২ সংস্থাকে চিঠি দিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলেছে, তারা যেন নিজেদের এলাকা পরিষ্কার রাখে। জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুর কবির প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি এককভাবে সিটি করপোরেশনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।